শিক্ষা ডেস্ক: সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ক্লাস শুরু হয়েছে ১ জানুয়ারি। এর আগে এই দুই স্তরে সব ধরনের ভর্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু রাজধানীর বহুল বিতর্কিত মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষাবর্ষ শুরুর দেড় মাস পর ফের অবৈধ ভর্তি করা হয়েছে। তাও এক-দুইজন নয়, ১৭ শতাধিক।১৭ ফেব্রুয়ারি তাদের ভর্তি সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ১২ মার্চ এই অবৈধ ভর্তি করা শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হবে। অভিযোগ উঠেছে, বিলম্বিত ওই অবৈধ ভর্তির পেছনে শিক্ষার্থীপ্রতি ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট।সে হিসাবে ভর্তি থেকে অন্তত অর্ধশত কোটি হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট মহলে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।এমন সব অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন বলেন, অভিযোগ আমাদের কাছেও এসেছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রসঙ্গত, ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী ভর্তির আগে আসন সংখ্যা ঘোষণা করার কথা। স্কুলটি এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঘোষিত আসনে গত ডিসেম্বরে ভর্তিও সম্পন্ন করে, যাদের ক্লাস চলছে এখন।
অবৈধ ভর্তিতে মধ্যরাতে রেজুলেশনে স্বাক্ষর : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গভর্নিং বডির মিটিং ও সিদ্ধান্ত ছাড়াই ১২ ফেব্রুয়ারি রাতের আঁধারে অবৈধ ভর্তির রেজুলেশনে স্বাক্ষর করেন গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেনন।পরের দিন গভীর রাত সাড়ে ১২টা থেকে গভর্নিং বডির অন্য সদস্যদের আলাদা আলাদাভাব ডেকে গোলাম আশরাফ তালুকদারের বাসায় রেজুলেশনে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়। অনেক আগে থেকেই ওই অবৈধ ভর্তির বিরোধিতা ও প্রতিবাদে বিক্ষোভের হুমকি দেন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু। এরপর তাকে গত ১৭ জানুয়ারি মতিঝিলের একটি রেস্টুরেন্ট থেকে দুপুর ১২টায় অপহরণ করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাকে ১০ ঘণ্টা আটকে রেখে ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিছিল-বিক্ষোভ করা যাবে না’ বলে মুচলেকা নেয়া হয়।
সিন্ডিকেট, বাসায় বাসায় ভর্তি : সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, স্কুলটির গভর্নিং বডির ১৩ সদস্যের মধ্যে দু’-একজন ছাড়া সবাই অবৈধ ভর্তির সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় এমপি হিসেবে পদাধিকার বলে এই স্কুলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান সংসদীয় শিক্ষা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য রাশেদ খান মেনন। তিনি ওয়ার্কার্স পার্টিরও সভাপতি। গভর্নিং বডির যে কোনো সিদ্ধান্তেই তার অনুমোদন লাগে।সূত্র জানায়, বাণিজ্যের তালিকা তৈরি, লেনদেন, তদবির এসব কিছু দেখাশোনা করেন মেননের পিএস নাইমুল আজম এবং মেননের ভাতিজা বলে পরিচয়দানকারী আতিক এবং ওয়ার্কর্স পার্টির মিডিয়ার দায়িত্ব পালনকারী ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন। নাইমুল আজম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) সাবেক কর্মকর্তা। এরা শুধু আইডিয়াল স্কুল ও ভিকারুননিসার অবৈধ বাণিজ্যে জড়িত নয়, অন্যান্য বাণিজ্য ও তদবিরও করে থাকেন।
অভিযোগ উঠেছে, স্কুলটির অবৈধ বাণিজ্যে গভর্নিং বডির দাতা সদস্য খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, কলেজ অভিভাবক সদস্য মাহবুবুল আলম, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আহমদ হোসেন, সদস্য সোহেল আহমেদও জড়িত। স্কুলের শিক্ষকদের বেশ কয়েকজনও অবৈধ ভর্তিতে জড়িত। গভর্নিং বডির সদস্যদের প্রত্যেককে ১০ থেকে ২৫টি করে ভর্তি করার সুয়োগ দেয়া হয়। স্কুলের অভিভাবক ও ওয়ার্কার্স পার্টি সূত্র জানায়, এ অবৈধ ভর্তির নেতৃত্বে রয়েছেন রাশেদ খান মেনন। এতে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার, ওই থানার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক টিপু ও কামরুল আহসান।বাণিজ্য নির্বিঘ্ন ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনে বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হালুয়ার ছিটেফোঁটা প্রতিপক্ষ বিরোধী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদেরও দেয়া হয়।
স্কুল সূত্রমতে, অবৈধ ভর্তি বাণিজ্যে স্কুলশিক্ষকদের একটি অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এদের মধ্যে নাটের গুরু বলে পরিচিতি শিক্ষক প্রতিনিধি আবদুস সালাম খান, তার ভাই ইঞ্জিনিয়ার আতিক, বাংলার শিক্ষক মহসীন রেজা, আবদুর রশিদ (ওরফে তত্ত্ব রশিদ), ইংরেজির কলিম মোরশেদ, বিজ্ঞানের মোয়াজ্জেম হোসেন ও গোলাম মোস্তফাও জড়িত। তবে বডির একমাত্র শিক্ষক প্রতিনিধি সদস্য ফেরদৌস হোসেন বাণিজ্যের ভাগ নেননি বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দেয়া তালিকা থেকে ১৭শ’ অবৈধ ভর্তি করা হয়েছে। সিন্ডিকেটচক্র স্কুলের পাশাপাশি তাদের বাসায় নিয়ে ভর্তি ফরম পূরণ করিয়ে নেয় অভিভাবকদের কাছ থেকে। প্রতিজন অবৈধ ভর্তিতে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেট।ছাত্রলীগের এক সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, দুই শিক্ষার্থী ভর্তিতে আড়াই লাখ করে মোট ৫ লাখ টাকা দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত করা যায়নি। সিন্ডিকেট আরও বেশি টাকা চায়।
বরাবরের মতো এবারও এই অবৈধ ভর্তি বৈধ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি, শিক্ষাবোর্ডের তদবির রাখা হয়েছে। রয়েছে পুলিশের তদবিরও। এসব সুপারিশে ভর্তি হয় কয়েকশ’। সূত্র জানায়, এবার পুলিশের সুপারিশে ৪৫, মাউশির ডিজি অফিস ১২, সাংবাদিক ১৪টিসহ বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে শতাধিক অবৈধ ভর্তি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৭ ফেব্রুয়ারি অবৈধ ভর্তি সম্পন্ন হয়েছে। ওই তারিখে মতিঝিল শাখায় বাংলা ও ইংরেজি প্রথম শ্রেণীতে দুই শিক্ষার্থীর অবৈধ ভর্তির দুটি রসিদও আমার দেশ-এর হস্তগত হয়েছে। তাতে দেখা যায়, বাংলা ভার্সনে ৮ হাজার ও ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ভর্তি ফি নেয়া হয়েছে। আগামী ১২ মার্চ এই অবৈধ ভর্তি করা শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হবে। সূত্র আরও জানায়, এর বাইরে আরও ৫ শতাধিক ভর্তির মিশন নিয়ে কাজ করছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট।
অভিভাবকদের ক্ষোভ : বৈধভাবে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছে, গত বছর একইভাবে দুই সহস্রাধিক অবৈধ ভর্তি করা হয়। যার মধ্যে সরকারি তদন্তে ১ হাজার ৫৫০ জনকে অবৈধ ভর্তির প্রমাণ মিলেছে। এ রিপোর্টের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ড গভর্নিং বডি এবং মাউশিকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ওই অবৈধ ভর্তির কারণে গেল বছর পরিস্থিতি এমন হয়েছিলো যে, শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে বসার জায়গা ছিল না। অভিভাবকরা জানান, মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের নাকের ডগায় এসব অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে।দুর্নীতিগ্রস্ত গভর্নিং বডির কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানান তারা।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেননের কাছে এ বিষয়ে ফোনে জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান। কখন এ বিষয়ে কথা বলবেন জানতে চাইলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে আইডিয়াল স্কুলের অধ্যক্ষ সাহানারা বেগমের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। মাউশির ডিজি ফাহিমা খাতুন বলেন, সরকারি স্কুলগুলোতে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বেসরকারি ক্ষেত্রে গভর্নিং বডির জন্য পুরোপুরি প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। তাহলে কি মাউশি ও মন্ত্রণালয় অবৈধ ভর্তি প্রতিরোধে ব্যর্থ—এমন প্রশ্নের তিনি কোনো সদুত্তর না দিয়ে বলেন, আমরা অবৈধ ভর্তি ঠেকাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আইডিয়াল স্কুলের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাউশির বিরুদ্ধেও অবৈধ ভর্তির সুপারিশের অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে তিনি বলেন, কারও সুপারিশ না রাখতে আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি।
২৩ ফেব্রুয়ারী/নিউজরুম