ঢাকা: যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ দখল করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হামলার পরিকল্পনায় ছিল সমমনা ইসলামী ১২ দলের আড়ালে জামায়াত-শিবির। পাশাপাশি গণজাগরণ মঞ্চকেন্দ্রিক সংবাদ পরিবেশনের ওপর জোর দেওয়ায় সাংবাদিকরাও তাদের টার্গেটে পরিণত হন।
শুক্রবার রাজধানীসহ সারা দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, শহীদ মিনার ও গণজাগরণ মঞ্চ ভাঙচুরের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পুলিশের বক্তব্য থেকে এমনই আভাস পাওয়া গেছে। রাজধানীতেই তাদের হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন সাংবাদিক। হামলায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের প্রকাশ্যেই দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে আগাম তথ্য ছিল, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর আড়ালে জামায়াত-শিবির পরিকল্পনা করেছিল, ব্লগার রাজীব হায়দারসহ ব্লগারদের ব্লগে লেখালেখিকে বিকৃত করে উপস্থাপনের মাধ্যমে সৃষ্ট ইস্যু নিয়ে গণজাগরণ চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ ও শহীদ মিনার টার্গেট করে হামলা চালিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গণজাগরণ মঞ্চের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিকে নস্যাৎ (ব্লগার রাজীবসহ সকল শহীদদের জন্য মসজিদে দোয়া) করতে শুক্রবার বায়তুল মোকাররমের গেটের বাইরে শতাধিক মুসল্লি বেশধারী নামাজ আদায় করেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রবাদী ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের উস্কানি দিয়ে জড়ো করা হয় বায়তুল মোকাররম মসজিদসহ শাহবাগের আশেপাশের মসজিদগুলোতে। জুমা’র ফরজ নামাজের পরপরই তারা ‘নারায়ে তকবির’ স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করে শাহবাগের দিকে রওনা হন।
যদিও ইসলামী ও সমমনা ১২ দল পুলিশকে কথা দিয়েছিল, তারা পল্টন থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত কর্মসূচি করবে। কিন্তু তারা ‘চলো, চলো শাহবাগ চলো, শাহবাগের আস্তানা ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও’ স্লোগান দেয়।
এক পর্যায়ে প্রেসক্লাবের সামনে কদম ফোয়ারার কাছে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে পড়ে তারা। এ সময় মৎস্য ভবন এলাকা থেকেও একটি মিছিল বের করা হয়। কিন্তু তারাও পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। রাজধানীর নিমতলী ও কাঁটাবন থেকেও ইসলামী দলের ব্যানারে জামায়াত-শিবির কর্মীরা শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়।
পল্টন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। তারা বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে পুলিশের ওপর বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। নামাজের আগেই মাছরাঙা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার আবদুল্লাহ তুহিন, এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান ইমরান তুহিন হামলার শিকার হন বায়তুল মোকাররম মসজিদের দেয়ালের মধ্যে। এ সময় আশেপাশের বিভিন্ন গলি থেকেও পুলিশের ওপর হামলা করা হয়।
কাঁটাবন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শাহবাগ থানা পুলিশের ওসি সিরাজুল ইসলাম আহত হন।
কারওয়ানবাজারেও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় জামায়াত-শিবির।
সূত্র জানায়, শহীদ রাজীব হায়দারের নামে ব্লগে ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য দিয়ে যে পরিস্থিতি ও ইস্যু তৈরি করা হয়, তার সুযোগ নিয়ে ইসলামী দলগুলো শুক্রবার বিক্ষোভ সমাবেশের যে কর্মসূচি দিয়েছিল, তাতে পূর্ণ সমর্থন দেয় জামায়াত। জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল, এ ইস্যুতে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা।
জামায়াত-শিবির ও সমমনা ইসলামী দলের হামলার শিকার হন মাছরাঙা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার আবদুল্লাহ তুহিন, এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান ইমরান তুহিন,এটিএন নিউজের স্টাফ রিপোর্টার ফেরদৌস ও দৈনিক জনকণ্ঠের ফটো সাংবাদিক শেখ মামুন রশিদ।
এ সময় পুলিশের সঙ্গে জামায়াত সমর্থকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন গাজী টিভির সাংবাদিক মাসুদুর রহমান, একাত্তর টিভির আরিফুজ্জামান পিয়াস, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির ক্যামেরাম্যান নুরুল ইসলাম, দৈনিক আমার দেশের চিফ ফটো সাংবাদিক মীরআহমেদ মীরু, সংবাদের সাইফ বাবলু, ডিআরইউ’র আপ্যায়ন সম্পাদক আমিনুল হক ভূঁইয়া এবং বিটিভির একজন ক্যামেরাম্যানসহ মোট নয় জন সাংবাদিক। আহত এসব সাংবাদিককেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ডিআরইউ, ক্র্যাব, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। তারা পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে আন্দোলনকারী বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের হাতে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, জামায়াত-শিবির চক্র একযোগে গণজাগরণ চত্বরে হামলার করার টার্গেট নিয়েছিল। এছাড়া রাজধানীর আরও কিছু গুরুত্ব পয়েন্টেও নাশকতার পরিকল্পনা করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আগাম প্রস্তুতি থাকার পরও তারা চট্টগ্রাম-রাজশাহী-বগুড়ায় গণজাগরণ চত্বরে হামলা করেন। হামলা করেন সাংবাদিকদের ওপরও।
পুলিশের মতিঝিল জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) শেখ নাজমুল আলম বলেন, ‘‘হামলার ধরন বলে দেয়, এটা পূর্বপরিকল্পিত। জামায়াত-শিবির ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঢুকে এ হামলা চালিয়েছে বলে পুলিশের ধারণা।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘তারা আমাদের কাছে মৌখিক অনুমতি নিয়েছিল, শান্তিপূর্ণ মিছিল করবে, কিন্তু কথা রাখেনি। উল্টো পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে।’’
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, ১৭ দিন ধরে শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরের সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হওয়ায় জামায়াত-শিবিরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতেই আঁতে ঘা লাগে তাদের। এজন্য তারা সংবাদকর্মীদেরও টার্গেট করে।
ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৩