কৃষি ডেস্ক: ফসল উত্পাদনে কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী বীজ সরবরাহ করতে পারছে না রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। দেশের মোট চাহিদা মাত্র ১১-১২ শতাংশ বীজ সরবরাহ করছে এ সংস্থাটি। বাকিটা বেসরকারি কোম্পানি ও কৃষকের সংগ্রহে থাকা বীজের ওপর নির্ভর করতে হয়। এদিকে বীজ সঙ্কটকে পুঁজি করে সারা দেশে নিম্নমানের বীজে সয়লাব হয়ে গেছে। কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী চটকদার নাম ও মোড়কে ভেজাল এবং নিম্নমানের বীজ বাজারজাত করছে। বিএডিসির বিরুদ্ধেও ভেজাল ও নিম্নমানের বীজ সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। এসব বীজ বপন করে কাঙ্ক্ষিত ফসল পাচ্ছেন না চাষীরা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
তবে বিএডিসির কর্মকর্তারা বীজ সঙ্কটের কথা স্বীকার করে জানান, বিগত বছরের তুলনায় বীজ উত্পাদন বেড়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বীজ উত্পাদন বাড়াতে নতুন খামার স্থাপন করা হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের চিরাচরিত প্রথানুযায়ী কৃষকরা নিজ গৃহেই শস্যবীজ সংরক্ষণ করে রাখেন। তবে নির্ভেজাল ও উন্নতমানের বীজের চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় বিএডিসির উপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তবে কৃষকের চাহিদা মেটাতে পারছে না সরকার।এছাড়াও বীজ উত্পাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা অর্জিত হয় না। বিএডিসির বীজ বিভাগ সূত্রে জানায়, ধান বীজ উত্পাদনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এরপরও ধান বীজের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। সারা দেশে উফশী রোপা আমন বীজের বার্ষিক চাহিদা ৯০ হাজার ৩৭৫ টন। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরে ২২ হাজার টন উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কাজ করছে বিএডিসি।বেসরকারি পর্যায় থেকে বাকি বীজ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন চাষীরা। একইভাবে দেশে উফশী বোরো বীজের চাহিদা ৯৩ হাজার ৭৫০ টন। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরে ৬০ হাজার টন উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আউস ধানের চাহিদা ১৫ হাজার টন। এর বিপরীতে ৩ হাজার ৫৬৯ টন উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সারা দেশে আলু বীজের চাহিদা ৬ লাখ টন থাকলেও এর বিপরীতে ২৩ হাজার টন বীজ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে বিএডিসি। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল হচ্ছে গম। দেশে গম বীজের চাহিদা ৬৩ হাজার ৭৫০ টন। সরকারি পর্যায়ে চলতি বছর ২২ হাজার টন উত্পাদন করা হচ্ছে। আরেক অর্থকরী ফসল পাট বীজের চাহিদা ৪ হাজার টন। এর বিপরীতে এক হাজার ৮৫০ টন উত্পাদন করা হচ্ছে।ডাল ও তেল বীজের চাহিদা ৪০ হাজার টন হলেও এর বিপরীতে ৩ হাজার ২০০ টন ও সবজি বীজের ২ হাজার ৮২২ টনের বিপরীতে ১২০ টন উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সরকার।
সরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত বীজ সরবরাহ করতে না পারার সুযোগ নিয়ে বাজারে ভেজাল ও নিম্নমানের বীজে ভরে গেছে। নিম্নমানের এসব সবজি বীজ কিনে কৃষকরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। এসব বীজ বিক্রি বন্ধ ও বীজ ব্যবহারে কৃষকদের নিরুত্সাহিত করতে স্থানীয় কৃষি বিভাগের তেমন কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।অভিযোগ রয়েছে, কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী অসাধু বীজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে কৃষকদের এসব বীজ কিনতে উদ্বুদ্ধ করছেন। ফলে এসব বীজ কিনে কৃষকরা প্রতারিত হয়ে সর্বস্বান্ত হলেও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেট ভারি হচ্ছে। যে কারণে ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের সবজি বীজ বিক্রি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতীয় নিম্নমানের পাট বীজে সয়লাব হয়ে গেছে বাজার। ব্যাপক চাহিদার সুযোগ নিয়ে বৈধ ও অবৈধ উভয় পথে ভারতীয় পাটবীজ দেশে আসছে। অবৈধ পথে আসা বীজের মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ভারতীয় অনেক ব্র্যান্ডের বীজ এ দেশে মাটি ও আবহাওয়ার উপযোগী নয়। এসব বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষক। এসব বীজে চারা গজানোর হার কম এবং ফলনও হয় কম। বীজ সঙ্কটের কারণেও পাট চাষে অনেক কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
এদিকে বিএডিসির ডিলারদের বিরুদ্ধে ভেজাল ও নিম্নমানের বীজ বিক্রির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। বিএডিসি’র বীজ কিনে বপন করে চলতি বছর প্রতারিত হয়েছেন নাটোর সদর উপজেলার দুই শতাধিক সরিষা চাষী। ওই এলাকার চাষীরা আগাম দেশীয় উন্নত টোরেন্টা ও বারী জাতের স্বল্পমেয়াদি সরিষা বপন করে। কিন্তু অর্ধেকের বেশি হয়েছে রাই। এদিকে রাই দেরিতে পাকার ফলে তারা বোরো আবাদ করতে না পেরে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। জামালপুরের বকশীগঞ্জে বিএডিসির বীজ কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেক কৃষক। উপজেলার বিএডিসির বীজ ডিলাররা নিম্নমানের ধান বীজ উত্তোলন ও প্যাকেটজাত করে সাধারণ কৃষকদের মাঝে বিক্রি করে। মুনাফালোভী বিভিন্ন ডিলারের কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকরা বীজতলা তৈরি করে এবং তা যথাসময়ে বপন করে। কিন্তু বাজার থেকে কেনা বীজতলায় বপনের পর অঙ্কুরোদগম হওয়ার পর মরে গেছে। আবার অনেক বীজতলা ১-২ ইঞ্চি হওয়ার পর তা আর বাড়ছে না।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বিএডিসির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিছু ডিলারের বিরুদ্ধে নিম্নমানের বীজ বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে তাদের সংখ্যা বেশি নয়। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায় তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
২৩ ফেব্রুয়ারী/নিউজরুম