২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩: এই খোঁয়াড়ে আমাদের পাঁচ সদস্যের সংসারে গতকাল আরও একজন যোগ হয়েছে। এখন সব মিলিয়ে আমরা ছয়জন। আমরা মানে মা আর আমরা দুই বোন, সঙ্গে জ্ঞাতি দুই খালা। মাকে সবাই বুড়ি নামে ডাকে, আমি ‘লালি’ আর আমার বোন ‘কালি’। খালাদের একজন ‘গলাছিলা’ আর অন্যজন ‘ধলা’ নামেই পরিচিত। এখন নতুন অতিথিকে আমরা ‘ধইল্যা’ নামে ডাকতে চাইলাম। কিন্তু এতে সে প্রবল আপত্তি তুলল। হতে পারে সে আমাদের ধলা খালার চাইতেও সুন্দরী, কিন্তু তাতে তো তাকে ধবল নামে ডাকা যায় না। তার জন্য ‘ধইল্যা’ নামটিই যুক্তিযুক্ত। তা ছাড়া এভাবে ডেকে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু সে যুক্তি দেখায়—এত দিন যেহেতু সবাই তাকে ‘ধবল’ নামে ডেকেছে, তাই আমাদেরও ডাকতে হলে তাকে ‘ধবল’ নামেই ডাকতে হবে। কী ঔদ্ধত্য! আমরাও অনড় থেকে বললাম, ‘ধবল’ নাম মুরগি জাতের জন্য নয়, ওটা বক প্রজাতির নাম। তবু সে অনর্থক তর্ক করল। বলল, ধবধবে ফরসা বলে বকের নাম যদি ‘ধবল বক’ হতে পারে, তবে মুরগির নাম কেন নয়? অকাট্য যুক্তি। তার পরও মেনে নিতে কষ্ট হলো, আমরা বুঝলাম, এ বড়ই তর্কবাগীশ আর অহংকারী। একে শায়েস্তা করতে হলে সম্মিলিত বুদ্ধির প্রয়োজন।
আমাদের সেই নতুন অতিথি, ধবল মুরগিকে তিন দিন ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে রাখা হলো। আমরা বেশ খুশি হলাম। কালি তো বলেই ফেলল, ‘অহংকার পতনের মূল।’ কিন্তু ধবল এ কথার কোনো উত্তর করল না। শুধু ছলছল চোখে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। আমরা তার আশপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করি। পাখনা মেলে কিছু নাচের মুদ্রাও দেখাই। সে কি হিংসা করছে? জানি না। সে কি দীর্ঘশ্বাস ফেলল? বুঝলাম না। বোঝার জন্য তার চারপাশে আরও কিছুক্ষণ ঘুরলাম। ঘুরতে ঘুরতে তার জন্য কেমন একটা মায়া অনুভব করি। বলি, ‘তোমার ভালোর জন্যই এমনটা করা হয়েছে। সব চিনে রাখো। নয়তো ছাড়া পেলে হারিয়ে গেলে তোমার নিজেরই বিপদ হবে।’
তার সঙ্গে কথা খুব কমই হয়। কেননা, সারা দিন বাইরে থাকি। মাঝে দু-একবার দেখা হয় আদার খেতে এলে। তখনো আমরা খুব হুড়াহুড়ি করি। বাইরের টানে। সে বলে, ‘এত হুড়াহুড়ি করো কেন? গলায় আটকাবে, আস্তে খাও।’
আমি বলি, ‘আমরা মুরগির জাত। মুখে তুলি আর গিলি। এখন কি মানুষের মতো চিবিয়ে খাব?’
—না, তা নয়। বাইরে কী কী ঘটল? কোথাও বদ মোরগের লড়াই বাধল কি না শুনতে চাচ্ছিলাম।
—এখন তোমার সঙ্গে খোশগল্প শুরু করলে গিন্নিমা যখন তাড়ানি দেবে, তখন তো খাওয়াই হবে না। এ ছাড়া ভরদুপুরে বক্ বক্ গিন্নিমার একদম সহ্য হয় না।
—আমার কথাটা একটু ভাব তো? সারা দিন…মায়ের চেঁচামেচিতে কিছুই শোনা হলো না।ইদানীং তার চিৎকার-চেঁচামেচি বড্ড বেড়েছে। খালারা কানাঘুষা করছে, মায়ের নাকি ডিম পাড়ার সময় হয়েছে। খুব ভালো কথা। যত ইচ্ছে ডিম পাড়ো আর গিন্নিমাকে খুশি রাখো। কিন্তু তাই বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করে সবার কান ঝালাপালা করার মানে কী? আর আজকাল মা সবার সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে।কথায় কথায় ঠোকর দেয়। বড্ড লজ্জা লাগে মায়ের এই ব্যবহারে। কিন্তু সে জন্য মায়ের কোনো অনুশোচনা নেই। বরং উল্টো মা অভিযোগ করে, আমরা নাকি এখনো মুরগি হতে পারিনি, সত্যিকারের মুরগি।
জানি না, সত্যিকারের মুরগি হওয়া মানে কী? তা কি কেবল ডিম পাড়া আর তা দিয়ে বাচ্চা ফোটানো? ‘গলা ছিলা’ খালার সঙ্গে মায়ের আর বিশেষ কোনো পার্থক্য রইল না। তার মতো মা-ও আজকাল পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করে।
ধবলকে নিয়ে সমস্যার শেষ নেই। একটা সমস্যা মিটে গেলে নতুন আরেকটা তৈরি করে। এ যেন সমস্যা তৈরির কারখানা। কোনো অজপাড়াগাঁ থেকে এসেছে বাবা? কোনো রুচিজ্ঞান নেই। যা পায় তা-ই খায়। আমরা আর যা-ই খাই, বাসি ভাত খাই না। ওটা খেলে কেমন ঝিমুনি আসে। কিন্তু তাকে তা বোঝাবে কে? গিন্নিমা দিচ্ছে, আর সে খেয়েই যাচ্ছে। আমরা তাকে আদরে-আল্লাদে বোঝালাম, ‘ভাই রে! গরিবের পেটে লাত্থি মেরো না। তুমি খেলে তা আমাদেরও খেতে হবে। ও আমরা খেতে পারব না।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা? গাঁইয়া ভূত কোথাকার! বলে কিনা, ‘ভাই, গরিবের ঘরে মুরগি হয়ে জন্মেছি। বাসি-পচা যা পেয়েছি তা-ই খেয়ে বড় হয়েছি। গায়ে তো মাংস তোমাদের চাইতে কম না। তাহলে কেন শুধু শুধু বড়লোকি দেখাব?’ আমি লালি, যে কিনা সুন্দর আর ভদ্র বলে আদরে আদরে বড় হয়েছি, সেই আমি তার পালকে পালকে ঠোঁট বুলিয়ে অনুরোধ করলাম আমাদের পায়ে কুড়াল না মারতে। অনুরোধ শুনে মনে হলো সে কিছুটা ভড়কে গেছে। গলাটা উঁচু করে চোখ বড় করে তাকাল। ঠোঁট ঘুরিয়ে নিজ পালকে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করল। একটু ভাবনাচিন্তার জন্য হয়তো সময় নিল। তারপর কক্ কক্ করে বলল, ‘কিছুটা সময় দাও। অনেক দিনের অভ্যাস বলে কথা।’ আমরা সানন্দে সময় দিলাম।
রাত পেরোলেই ধবল ঘরের বাইরে বেরোবার অনুমতি পাবে। সবাই মিলে তাকে কিছু না কিছু কৌশল শিখিয়ে দিলাম। কোন কোন চিহ্ন ধরে ঘরে ফিরতে হবে, ঠিক কখন খেতে আসতে হবে।বাইরের কোনো শত্রু তাড়া করলে কী করে সাহায্য চাইতে হবে ইত্যাদি। বারবার তাকে সতর্ক করা হলো, প্রথম দিনেই যেন বেশি দূর না যায়। শেষে পথ হারিয়ে ফেলবে। এসব উপদেশ দিতে দিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু রাত না পেরোতেই ধবলের হাঁকডাকে ঘুম ভেঙে গেল। তখনো পাড়াতো মোরগেরা রাত পোহাবার সংকেত দেয়নি। খুব রাগ হলো। ইচ্ছে হলো দু-চারটা ঠোকর মারি। কিন্তু নিজেকে সংযত করলাম। নতুন জায়গায় বেচারির প্রথম বাইরে যাওয়া বলে কথা!
নির্দিষ্ট সময়ে যখন খোঁয়াড় থেকে বেরোলাম, ধবলকে এক গলা খেয়ে নিতে বললাম। কারণ, সারা দিন যত ছোটাছুটি করতে হবে, ঝোলাভর্তি খাবার হজম হতে বেশি সময় লাগবে না। নিজেও খাব বলে খাবারের দিকে এগিয়ে গেলাম। মনে মনে গিন্নিমার মেয়েটার আদরের জন্য তৈরি হলাম। প্রতিদিন সকালে খাবার খেতে খেতে আমি মেয়েটার আদর খাই। ও আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর আমি চোখ মুদে আদর খেতে থাকি।শেষে মেয়েটার হাতের মুঠোয় রাখা চাল ঠুকরে খেয়ে খাবার সমাপ্ত করি।কিন্তু আজ সে রকম কিছু ঘটল না। বরং দেখলাম, ধবলকে আদর করছে মেয়েটা। ধবল কুঁই কুঁই করে আদর খেতে লাগল। আমার বুকটা ফেটে গেল। চোখ ছলছল করে উঠল। বোকা মেয়েটা আমার কষ্ট টেরও পেল না। মানুষ এমনই, এমনই অকৃতজ্ঞ। অথচ এত দিন এই মেয়েটাকে আনন্দ দিতে আমি কী না করেছি! আমাকে ধরতে এলে, কোলে নিতে চাইলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছি। অনুগত ভৃত্যের মতো তার পায়ে পায়ে ঘুরেছি। কালি কখনো এমনটা করেনি। ধরতে গেলে দৌড়ে পালিয়েছে। আজ মনে হচ্ছে ভুলটা হয়তো আমারই ছিল।
মনটা একদম ভেঙে গেল। ভাঙা মনে আমি ধবলের ধ্বংস কামনা করলাম। ওকে তখন খুব কুৎসিত মনে হলো।
সারা দিন ধবলকে এড়িয়ে চললাম। মাঝে একবার মুখোমুখি হয়েই বলল, ‘আমার কী দোষ?’ দুপুরে বরইগাছের নিচে বালুতে বুক ডুবিয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে আমারও একবার মনে হয়েছে, সব দোষ হয়তো ধবলের একার নয়, আমারও কিছু আছে। যাকগে, ঘরে ফিরে সব মিটমাট করে নেব।
কিন্তু সন্ধ্যায় ও খোঁয়াড়ে ফিরল না। গিন্নিমার মেয়েটা পাড়াময় খুঁজে বেড়াল। কোথাও পাওয়া গেল না। কক্ কক্ কক্ করে গলা ছাড়িয়ে ডাকলাম। কোনো সাড়া নেই। অচেনা পথে ধবল কি তবে পথ হারিয়েছে? ধবল আর এল না। ধবলকে চিরতরে হারিয়ে বুঝলাম, ‘হিংসা শুধু ক্ষতিই বাড়ায়।’
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টl
পাবলিক কলেজ, চট্টগ্রাম