মাথা না নোয়ানোর একুশ নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি সমুন্নত রাখতে হবে

0
169
Print Friendly, PDF & Email

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩।।

আবার ফিরে এলো অমর একুশে। ভাষাশহীদ দিবস। এক অনন্য অবিস্মরণীয় ইতিহাস। রক্তের ওপর দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদার দাবি অর্জনের ইতিহাস। জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃতি দিয়েছে এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব বাংলার গণমানুষের প্রাণের ছোঁয়া পাওয়া এক অসাধারণ ঘটনা। বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে জনগণ অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন।

প্রথমে তমদ্দুন মজলিশ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলে। এ দাবির পক্ষে অবস্থান নেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। ১৯৪৮ সালেই তারা রাষ্ট্রভাষার দাবিকে অনেকটা জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হন। এই দাবি এতটা গণসম্পৃক্ত হয়ে উঠেছিল যে, ১৯৫২ সালের শুরুর দিকে এটি গণমানুষ তথা ছাত্র-জনতার প্রধান দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। তারই ফল ছিল একুশের আন্দোলন ও আত্মত্যাগ। পাকিস্তান সরকার ভাষার দাবির তাৎপর্য বুঝতে পারল না; মাতৃভাষার প্রতি সহজাত ভাবাবেগ উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো না। শাসকচক্র হঠকারিতার পরিচয় দিলো, গণমানুষের প্রাণের দাবিকে বন্দুকের গুলিতে উড়িয়ে দিতে উদ্যত হলো। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে পুলিশ বাধা দিলো লাঠি, টিয়ার গ্যাস ও গুলি ছুড়ে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই অপ্রতিরোধ্য মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হলেন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকেরা।

মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাওয়ার দাবি ছিল ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক। পুরো পাকিস্তানে বাংলাভাষীরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্য দিকে উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই ভাষা ছিল না। শাসকেরা অত্যন্ত অদূরদর্শিতার সাথে বাঙালির দাবিকে পদদলিত করার প্রয়াস পেয়েছিল। বলদর্পী শাসকদের হঠকারিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার ফলে ’৫২ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশের ভ্রƒণ জন্ম নিয়েছিল বলে অনেকের অভিমত।

একুশেকে বলা হয় মাথা নত না করার প্রেরণা, একুশে তথা ভাষা আন্দোলনের রক্তরাঙা পথ মাড়িয়েই স্বাধিকার আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। এক দিকে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন, অপর দিকে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্ষোভÑ এ দুটোর মেলবন্ধনে স্বাধিকার আন্দোলন ক্রমান্বয়ে তীব্র বেগ পায়। অবশেষে ১৯৭০-এ নির্বাচিত দলকে ক্ষমতায় বসতে না দেয়ার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ জনগণকে স্বাধীনতার পথে পা বাড়াতে বাধ্য করে। ৯ মাস যুদ্ধ করে জনগণ স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে মাথা নত না করার শিক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।

মাতৃভাষার জন্য আমাদের ঐতিহাসিক আন্দোলন বিশ্ববাসীকেও স্পর্শ করেছে। ফলে আজ আমাদের ভাষাশহীদ দিবস বিশ্বের তাবৎ মানুষের মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। প্রাণের উচ্ছ্বাস ও চেতনার তীব্রতায় বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। অথচ সেই ভাষা আজ দূষণের শিকার এবং একুশের চেতনা ভূলুণ্ঠিত। হিন্দির আগ্রাসন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বাংলা ভাষা ও দেশীয় সংস্কৃতির পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতি। উচ্চবিত্তের পরিবারে এখন বাংলা অপাঙ্ক্তেয়, সর্বত্র হিন্দি ও বিজাতীয় সংস্কৃতির সয়লাব। আজ আদালতকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাংলা ভাষার দূষণ রোধে ভূমিকা নিতে হচ্ছে।

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার ইতিহাসও আজ বিকৃতির শিকার। ভুয়া ভাষাসৈনিকদের ইচ্ছাপত্রকে ইতিহাস বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এর সাথে রাজনৈতিক রঙ এতটা বেশি ছড়ানো হচ্ছে যে, নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে ব্যর্থ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দেখা যাচ্ছে না। ইন্টারনেটে ব্যবহারের ক্ষেত্রে হিন্দি, উর্দু ও নেপালিদের ভাষাও অনেক ক্ষেত্রে বাংলার চেয়ে এগিয়ে গেছে।

একুশ এখন অনেকটা আচারসর্বস্ব, মেলাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এ দিকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলতে একটা অপশক্তি উদ্যত। এভাবে চলতে দিলে আরেকটি ভাষা আন্দোলন ছাড়া বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে স্বমহিমা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমরা এই মহান দিনে ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ এবং তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। সেই সাথে মাথা নত না করার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরেকটি সর্বাত্মক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাষা-সংস্কৃতিকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাচ্ছি।

শেয়ার করুন