২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে, এসেছে ফাগুন। ফাগুনের এমনই ফুলফোটা দিনে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শহীদ হয়েছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং নাম না জানা আরো অনেকে। যে দিন আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। সেই অমর শহীদদের স্মরণে আমাদের প্রাণে বারবারই বেজে ওঠে গানের একটি কলিÑ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কী ভুলিতে পারি।
সাধারণভাবে ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা ১৯৫২ সালের আন্দোলনকে বুঝি; যা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকে। এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা, গল্প-উপন্যাস, নাটক এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে সর্বপ্রথম কবিতা রচনা করেন চট্টগ্রামের ‘সীমান্ত’ পত্রিকার সম্পাদক মাহবুবুল আলম চৌধুরী। তার কবিতার নামÑ কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। ঢাকায় পুলিশের গুলি চালানোর খবর একুশে ফেব্রুয়ারির বিকালে চট্টগ্রামে পৌঁছালে এই কবিতাটি সন্ধ্যার মধ্যেই রচিত হয়। সেই রাতেই কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে কবিতাটি ছাপানো হয়। পরের দিন বাইশে ফেব্রুয়ারি লালদীঘির ময়দানে আয়োজিত বিশাল প্রতিবাদ সভায় ওই ‘কাব্যপুস্তিকা’ বিলি করা হয় এবং কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনানো হয়। মুসলিম লীগ সরকার এক আদেশবলে কবিতাটি প্রায় সাথে সাথে বাজেয়াপ্ত করে। এই একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রতি বছর অসংখ্য কবিতা প্রকাশিত হয়। আমাদের অজস্র কবিতার পাতায় পাতায় একুশের চেতনা চিরভাস্বর হয়ে আছে।
একুশের চেতনা চিত্রিত হয়েছে আমাদের উপন্যাসের পাতায় পাতায়। একুশকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অনেক উপন্যাস। এই উপন্যাসগুলোর মধ্যে আবু রুশদের ডোবা হল দীঘি (১৯৬৬), নোঙর (১৯৬৭), জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯), সরদার জয়েন উদ্দীনের বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ (১৯৭৫), সেলিনা হোসেনের যাপিত জীবন (১৯৮১), নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি (১৯৮৫), কথাশিল্পী শওকত ওসমানের আর্তনাদ (১৯৮৫), মোহাম্মদ আবদুল আউয়ালের আলো আমার আলো (১৯৯০) ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঔপন্যাসিকদের কেউ কেউ ভাষা আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছেন, কেউ বা ভাষা আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। আবার কেউ বা ইতিহাসের পাতা থেকে ভাষা আন্দোলনকে তুলে এনেছেন সাহিত্যের পাতায়। লেখকের প্রত্যক্ষ জীবন-অভিজ্ঞতা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতা উভয়ই ভাষা আন্দোলনভিত্তিক উপন্যাস রচনায় সহায়তা করেছে। ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলো যেন ভাষা আন্দোলনেরই আরেক দলিল।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৩ সালে মুনীর চৌধুরী রচনা করেন ‘কবর’ নাটক। লেখক তখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাজবন্দী ছিলেন। আসন্ন শহীদ দিবস উপলক্ষে জেলখানায় একটি নাটক মঞ্চায়নের জন্য এটি রচিত হয়। এই নাটক রচনার জন্য অনুরোধ করেছিলেন মুনীর চৌধুরীর সহকারী রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত। ফনী চক্রবর্তীর পরিচালনায় জেলখানায় এই নাটক একুশে ফেব্রুয়ারির রাত ১০টার পর মঞ্চস্থ হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে যখন পুলিশের গুলিতে নিহত সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের মতো অনেক ছাত্র-জনতার মৃত্যু হয়েছিল এবং অতঃপর লাশগুলো গোরস্থানে এনে মাটিচাপা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছিলÑ নাটকের ঘটনা শুরু সেখান থেকে। মাটিচাপা দেয়ার সময় কবর খননকারী আপত্তি জানায়Ñ ‘মুসলমানের মুর্দা, দাফন নেই, কাফন নেই, জানাযা নেইÑতার ওপর একটা আলাদা কবর পর্যন্ত পাবে না? এ হতে পারে না।’
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, যেগুলোতে স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভাষাপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলো হচ্ছেÑ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’, ড. মুহম্মদ এনামুল হকের ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা পরিপ্রেক্ষিত উর্দু ও বাংলা’, কাজী মোতাহার হোসেনের ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ ইত্যাদি।
ছেলেমেয়েদের দেহ-মনকে পুষ্ট করে তোলার জন্য মাতৃদুগ্ধের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি মাতৃভাষায় শিক্ষাদান কিংবা জ্ঞানচর্চার কোনো বিকল্প নেই। মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা তথা শিক্ষা গ্রহণের ফলেই আমাদের জীবনীশক্তি ক্রমেই সজাগ এবং জীবন্ত হয়ে ওঠে। অন্য ভাষার শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে তা সম্ভবপর নয়।মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষের ভাবের উদ্দীপনা এবং প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে।মানুষের অনুভব শক্তি, চিন্তাশক্তি এবং কল্পনাশক্তি বৃদ্ধির জন্য মাতৃভাষা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষের চিন্তা কিংবা ভাবের খোরাক মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষা দিতে পারে না। অন্য ভাষা থেকে জ্ঞান আহরণ করলেও তাকে অনুভব করার জন্য মাতৃভাষায় চিন্তা করতে হয়। মূলত শিক্ষায় তথা জ্ঞান-চর্চায় মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে শিশু এবং কিশোরদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা অপরিহার্য। অন্যথায় একটি শিশুর অফুরন্ত ভবিষ্যৎ, উজ্জ্বল সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে পারে। শিশুর সাংস্কৃতিক মান উন্নত, তার দক্ষতা বিকশিত, নৈতিক ও সামাজিক চেতনা সুন্দরভাবে জাগ্রত করতে হলে তাকে অবশ্যই তার মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা এবং শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেনÑ “মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষার কল্পনাসুন্দরী তার মন মজান, ভাবের ছবি আঁকে? কাহার হৃদয় এত পাষাণ যে মাতৃভাষার অনুরাগ তাহাতে জাগে না? পৃথিবী ইতিহাস আলোচনা করিয়ে দেখ মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত কোনও জাতি কখনো কি বড় হইতে পারিয়াছে?” ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যথার্থ অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, মাতৃভাষার শক্তি অপরিসীম। আজকের বিশ্বে চীন, জাপান, জার্মান ইত্যাদি দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পেরেছে মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে। বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে হলে মাতৃভাষা বাংলায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনÑ “বাংলা শিক্ষা যখন বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে তখন আমরা ইংরেজি শিখিতে আরম্ভ করিয়াছি।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নোবেল-পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন কবি শৈশবে আগে বাংলা ভাষা শিখেছেন, অতঃপর ইংরেজি ভাষা শিখতে শুরু করেছেন। অথচ বর্তমান বাংলাদেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে বাঙালির সন্তানদের কাঁধে বাংলা শিক্ষার আগেই অনেক ইংরেজি বইয়ের বোঝা চাপানো হয়।স্কুল কর্তৃপক্ষ এটা উপলব্ধি করেন না যে, শিশুর মানসিক বিকাশ মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্ভবপর এবং মাতৃভাষার ভিত্তি গড়ে উঠলে শিশুর এমন কিছু ভাষাজ্ঞান জন্মে যার ফলে ইংরেজি কিংবা অন্য কোনো ভাষা শিক্ষা সহজতর হয়। শিশুদের কাঁধে একাধিক ইংরেজি বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে মূলত তাদের মানসিক বিকাশের শক্তি অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেনÑ “আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি এমনই হউক, যাহা আমাদের জীবন শক্তিকে ক্রমেই সজাগ, জীবন্ত করিয়া তুলিবে।” মূলত মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা ব্যতীত জাতিকে সজাগ ও জীবন্ত করে তোলার আর কোনো উপায় নেই।
বিশ শতকের শেষের দিকে বিশ্বের সব জাতিই মাতৃভাষার গুরুত্বকে উপলব্ধি করেছে। বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থী স্বদেশী ভাষায় কথা বলে অর্থাৎ যাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে তাদের সেই ভাষায় শিক্ষাদান করা দরকার। একটি অনুন্নত ভাষা উন্নত ভাষার চাপে কালের প্রবাহে হারিয়ে যেতে পারে তথা তার অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। একটি অনুন্নত ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রদান করা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় প্রদান করা হলে অনেক উপেক্ষিত অবহেলিত জাতিসত্তার ভাষার কিছুটা বিকাশ ঘটবে। বাংলাদেশে যেসব ুদ্র জাতিসত্তার অস্তিত্ব বিদ্যমান সেগুলোর অনেকেরই কোনো বর্ণমালা নেই। অনেক ভাষার বর্ণমালা থাকলেও উন্নতমানের লিখিত সাহিত্য নেই।
আবার কারো লিখিত সাহিত্য থাকলেও জনসংখ্যার দিক থেকে এসব ভাষাভাষীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। ফলে ুদ্র জাতিসত্তার ভাষাগুলোকে শিক্ষার মাধ্যম করা বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত, একটি দেশের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তবে ুদ্র জাতিসত্তার কিছু কিছু ভাষা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যেমন, সাঁওতালী ভাষা। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে, সাঁওতাল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে সেসব বিদ্যালয়ে সাঁওতালী শিশুদের জন্য বাংলা ভাষা শিক্ষা দেয়ার সময় সাঁওতালী ভাষার সাহায্য নেয়া হয়। মূলত জ্ঞানচর্চায় মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেইÑ এটাই সত্য কথা।
মায়ের মুখ থেকে, সামাজিক পরিবেশ থেকে আমরা যে ভাষা শিখে থাকি তা মূলত আঞ্চলিক ভাষা। আমাদের শিখতে হবে প্রমিত ভাষা। প্রমিত বলতে বোঝায় আদর্শ বা সর্বজনস্বীকৃত রূপ। ইংরেজিতে যাকে বলে স্ট্যান্ডার্ড। বাংলা ভাষার প্রমিত ব্যবহার বলতে বোঝায় প্রমিত বানান, প্রমিত বাক্য, প্রমিত উচ্চারণ ইত্যাদি।সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার প্রমিত ব্যবহার করা যাবে কি নাÑ তা একটি বিতর্কের বিষয়। কেননা ভাষা ব্যবহারে দু’টি পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। একটি হচ্ছে আনুষ্ঠানিক এবং অন্যটি হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক কিংবা ঘরোয়া। ইংরেজিতে যাকে বলে ফরমাল এবং ইনফরমাল। ঘরে আমরা যেসব কথাবার্তা বলি তাতে প্রমিত বাংলাই ব্যবহার করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ঘরে প্রমিত বাংলার ব্যবহার নিঃসন্দেহে প্রশংসারযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ঘরে বা ঘরোয়া পরিবেশে সাধারণত আঞ্চলিক ভাষাই বেশি ব্যবহার করে।
এখন ঘরোয়া কথাবার্তা বাদ দিয়ে আমরা যখন আনুষ্ঠানিক কথাবর্তা বলিÑ অফিস-আদালতে, ব্যাংক-স্কুল-কলেজ, মার্কেটে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে, সভায় ইত্যাদি তখন অবশ্যই আমাদের প্রমিত বাংলা ব্যবহার করা উচিত। এটা শুধু উচিতই নয়, বলা যায় একান্ত আবশ্যক।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক যদি প্রমিত উচ্চারণ করতে না পারেন তবে তিনি ছাত্রদের কী শেখাবেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের কাছে হাসির পাত্র হতে পারেন।বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-অধ্যাপকেরা যদি প্রমিত বাংলা না বলতে পারেন তবে তা জাতীয় জীবনে নিষ্ঠুর পরিহাস বলে বিবেচিত হয়। কাসে ছাত্রদেরকেও অবশ্যই প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতে হবে। আমাদের বেশির ভাগের শিকড় যেহেতু গ্রামে, তাই অনেকের পক্ষেই গ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ত্যাগ করা সম্ভবপর তো নয়ই, প্রমিত বাংলা বলতে গেলে আঞ্চলিকতা প্রকাশ পায়। তবে চেষ্টা করলে যে কেউই প্রমিত বাংলা আয়ত্ত করতে পারে। বিশেষ করে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা অনেক সময় প্রমিত উচ্চারণে পাঠদানে ব্যর্থ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রমিত উচ্চারণ শিখতে পারে না।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেও দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী চোরকে চুর, ঘোড়াকে ঘুরা, সোজাকে সুজা, পোকাকে পুকা, প্রতিভাকে পতিভা, প্রতিকে পতি, প্রচেষ্টাকে পচেষ্টা, প্রণামকে পনাম ইত্যাদি উচ্চারণ করে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের আঞ্চলিক উচ্চারণে যেহেতু চন্দ্রবিন্দু উচ্চারিত হয় না, এজন্য দেখা যায় বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ চাঁদকে চাদ, বাঁকাকে বাকা, বাঁশিকে বাশি বলে থাকেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে আঞ্চলিক উচ্চারণ থাকলে তা কোনো দোষের নয়। কিন্তু একজন শিক্ষক-অধ্যাপক, একজন বড় কর্মকর্তা, একজন উপাচার্য, একজন জেলা প্রশাসক, একজন পুলিশ সুপার, একজন রাজনৈতিক বড় নেতা যদি প্রমিত উচ্চারণ করতে না পারেন, আনুষ্ঠানিক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে যদি আঞ্চলিকতার প্রভাবে প্রভাবিত হন, তাহলে বড়ই লজ্জার কথা। তারা যদি দেশকে দ্যাশ বলেন, নেতাকে ন্যাতা বলেন তাহলে বড়ই হাস্যকর মনে হয়। বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। তাই বাংলাদেশে যেকোনো চাকরির পূর্বশর্ত হওয়া উচিত প্রমিত বাংলা লেখায় এবং বলায় পারদর্শী হতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে শর্ত এখনো চাকরি ক্ষেত্রে জুড়ে দেয়া হয় না। এমনকি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যারা বাংলা খবর পড়েন তাদের মধ্যেও অনেক সময় প্রমিত উচ্চারণ শোনা যায় না।
প্রমিত বাংলা লেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে বাংলা বানানের জগতে। চলিত ভাষা চালু হওয়ার ফলে বানানে বিশৃঙ্খলা বেশি করে দেখা দিয়েছিল।এজন্য বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে বিশ্বভারতীর উদ্যোগে চলতি ভাষার বানানের একটি নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়েছিল। পরে বাংলা বানানকে প্রমিত করার জন্য ১৯৩৬-৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানানের নিয়ম বেঁধে দেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত বানানের নিয়মে বেশ কিছু বিকল্প ছিল। যে কারণে বানানের সমতা আনা সম্ভব হয়নি। ১৯৯১ সালে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন’ নামে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা ব্যবহার বিধি’ প্রকাশ করে। এই বানান তাদের পত্রিকায় ব্যবহৃত হওয়ায় বানানের জগতে নতুন নতুন পরিবর্তন আসতে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের উদ্যোগে ‘পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের সমতা বিধানের লক্ষ্যে’- কুমিল্লায় এক কর্মশিবির অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালের নভেম্বরে এই কর্মশিবিরে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ‘পাঠ্য বইয়ের বানান’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এই নিয়ম অনুযায়ী বোর্ডের বই মুদ্রিত হতে থাকে। বাংলা বানানকে প্রমিত করার লক্ষ্যে বাংলা একাডেমী ১৯৯২ সালে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে রিপোর্ট তৈরি করে এবং বিভিন্নজনের মতামত নিয়ে ১৯৯৪ সালে এটিকে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করে। বানানের এই নিয়ম অনুযায়ী বাংলা একাডেমীর বই প্রকাশিত হচ্ছে।এই প্রমিত বানান বেশির ভাগ লেখক বুদ্ধিজীবীর মাঝে গৃহীত হয়েছে এবং বিভিন্ন স্তরে তা ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের সবারই উচিত সর্বস্তরে প্রমিত বাংলা বলা এবং লেখা।
যেকোনো ভাষার বিকাশ সাধিত হয় প্রধানত তিনটি কারণে। এক. জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাধ্যম হিসেবে ভাষার ব্যবহার, দুই. রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসনে ভাষা ব্যবহার, তিন. মিডিয়ার জগতে ভাষার ব্যবহার। এই তিনটি স্তরে যদি কোনো ভাষা ব্যবহৃত হয় কিংবা প্রয়োগ করা হয় তবে সেই ভাষা দ্রুত বিকশিত হয় এবং সে ভাষার ক্ষেত্রে বলা যায় যে সেটি সর্বস্তরে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই তিনটি স্তর ব্যতীত আরেকটি ব্যবহারিক স্তর রয়েছে, যা ভাষা বিকাশের জন্য প্রাথমিক এবং আবশ্যিক শর্ত এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় স্তর। তা হচ্ছেÑ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কথ্য বা প্রমিত ভাষার ব্যবহার।
বাংলা ভাষার ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, এটি জন্মলগ্ন থেকেই কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এ ভাষা প্রথম ব্যবহৃত হয় ধর্মাচার বাহন হিসেবে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সাধন-ভজনের ভাষা। মূলত ধর্মীয় শিক্ষার কারণেই এ ভাষা প্রথম লিখিত রূপ পায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা সাহিত্য। এই সাহিত্যের মাধ্যমেই বাংলা ভাষা প্রথম বিকশিত এবং ব্যবহৃত হয়। লিখিত সাহিত্য ব্যতীত প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা লোকসাহিত্য তথা প্রবাদ প্রবচন, ছড়া, রূপকথা, পাঁচালী, লোকগাথা ইত্যাদিতে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। মূলত সাহিত্যের বাহন হিসেবে বাংলা ভাষা প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক যুগে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়েছে। এক সময় মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার বইগুলো উর্দু ভাষায় রচিত হতো, এখন সেগুলো বাংলা ভাষায় রচিত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাÑ তথা মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য শাখার বইগুলো উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বাংলা ভাষাতেই রচিত হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইগুলো বাংলা এবং ইংরেজিতে রচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষালাভের জন্য আমাদের ইংরেজি না শিখলে যেমন চলবে না, তেমনি আবার ইংরেজির জন্য বাংলা ভাষাকে অবহেলা করাও সঠিক হবে না। মূলত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা এবং ইংরেজি পাশাপাশি চালাতে হবে। মানবিক শাখা ব্যতীত বিজ্ঞান, বাণিজ্য, চিকিৎসা এবং প্রকৌশল শিক্ষায় ইংরেজি ভাষার আধিপত্য রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। তবে এসব শিক্ষার বই যে বাংলা ভাষাতেও লেখা যায় তা ভুললে চলবে না। বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে ব্যবহার করতে হলে জ্ঞানের সব শাখায় তার ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে প্রশাসনে তথা, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার ছিলই না বলা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানে বাংলা পেল রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা কিন্তু সরকারি আমলারা বাংলা লিখতে অভ্যস্ত ছিলেন না। এজন্য ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অফিস আদালতে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশ জারি করা হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়Ñ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ করেছি যে, স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও বেশির ভাগ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বৎসর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথিতে লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না।’ মুজিব সরকারের পরবর্তী সরকারগুলোও অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না। এখনো নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হলেও উচ্চ আদালতের রায় কমই বাংলা ভাষায় দেয়া হয়।
মিডিয়ার জগতে ভাষার ব্যবহারের কথা প্রসঙ্গে বলা যায়Ñ প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এখন বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে অনেক বাংলা দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকা রয়েছে এবং অনেক বাংলা টিভি চ্যানেলে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের অঙ্গীকার হোক মহান একুশের মাসেÑ এই প্রত্যাশা করি।