২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: চীনে যঁারা গেছেন, তঁাদের সবাই ভাষা নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। যেকোনো দোকান, দপ্তর এমনকি রাস্তার সাধারণ মানুষ ইংরেজি বোঝে না বললেই চলে। কেনাকাটার ক্ষেত্রে একমাত্র গণনাযনে্ত্রর ইংরেজি হরফ ছাড়া যোগাযোগ করা প্রায় দুঃসাধ্য।
আমাদের আশপাশেই কেউ না কেউ আছেন, যিনি বৃত্তি নিয়ে জাপানে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন। তঁাকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন, যে বিষয়ে তিনি পড়তে গিয়েছিলেন, সেই পড়াশোনা শুরুর আগে জাপানি ভাষাটা রপ্ত করতে হয়েছে। তারপর জাপানি ভাষার বই, জাপানি ভাষায় শিক্ষকের বক্তৃতা বোঝা∏এসব করেই উচ্চতর ডিগ্রি নিতে হয়েছে। জাপান তো বটেই ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি বেশ কয়েকটি দেশে সাড়া জাগানো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকও দেখা যায় নিজের ভাষায়।
বিদেশিদের সঙ্গে, আন্তর্জাতিক বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির ব্যবহার সব সময় চলতেই পারে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে যখন চিঠি লেখালেখি বা দেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ, সেটির মাধ্যম ইংরেজি হওয়ার প্রয়োজন কী?
Èমধুর আমার মায়ের ভাষা…‘ বলে যতই আমরা আবেগে মথিত হই না কেন, কার্যত ব্যক্তিগত বা দাপ্তরিক যোগাযোগ আমরা করি হয় ইংরেজিতে, না হয় বাংলা-ইংরেজির মিশেল দিয়ে। অথচ সেই কবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন, Èআগে চাই বাংলা ভাষার গঁাথুনি, তার পরে ইংরেজি শেখার পত্তন।‘
লেখক ও উপস্থাপক ফরহাদ খান বললেন, Èযখন চিঠির চল ছিল তখন পিতা-সন্তানের যোগাযোগটা বাংলাতেই হতো। এফএম রেডিও আর মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের হাত ধরে অদরকারি ইংরেজির ব্যবহার শুরু হয়েছে। আর এটা এমন, যেখানে বাংলা-ইংরেজি কোনো ভাষাতেই পূর্ণাঙ্গ কোনো বাক্য বলা হয় না।‘
ফরহাদ খানের মতে, যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় সব শব্দ বাংলায় থাকা সত্ত্বেও ইংরেজির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, Èবাংলা ভাষার প্রতি দায়িত্ববোধ কমে যাচ্ছে। বাংলা ভাষা টিকিয়ে রেখেছে সংবাদপত্র আর গণমাধ্যমকর্মীরা। আসলে জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে যে অহংবোধ থাকা উচিত ছিল, তা নেই।‘
প্রযুক্তির এই যুগে লেখালেখির কাজটা অনেকটাই কম্পিউটারনির্ভর হয়ে গেছে। কম্পিউটারে বাংলা লেখার চল অনেক দিনের। এখন ইন্টারনেটেও বাংলা লেখা সহজ। ই-মেইলটাও বাংলায় লেখা যায়। শুধু কি-বোর্ডের কোনো বোতামে কী অক্ষর আছে, তা জেনে নিলেই চলে। কোনো কি-বোর্ড মুখস্থ না থাকলেও ধ্বনিনির্ভর কি-বোর্ড ব্যবহার করে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখা যায় (যেমন ami = আমি)।
জনপ্রিয় বাংলা সফটওয়্যার বিজয়ের নির্মাতা মোস্তাফা জব্বার স্পষ্ট করেই জানালেন, ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগেও আজ বাংলা ব্যবহারে তেমন কোনো সমস্যা নেই। তিনি বললেন, Èঅ্যাপলের ট্যাবলেট ছাড়া আর সব ট্যাবলেট কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে বাংলা লেখা যায়। পুরোনো প্রযুক্তির কিছু মুঠোফোনে খুদে বার্তা লেখার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সুবিধা নেই। সেখানে অনেকে রোমান হরফে বাংলা লিখে যোগাযোগ করেন।‘
নতুন প্রজন্মের বাংলা ব্যবহার নিয়ে অনেকের সংশয় থাকলেও মোস্তাফা জব্বার আশ্বস্ত করে বললেন, Èফেসবুক দেখেন, সেখানে বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে বাংলায় লিখছে।‘ তবে তিনি যোগ করলেন, বেসরকারি খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ইংরেজিনির্ভর।
একটা ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা জানালেন চাকরিবিষয়ক ওয়েবসাইট প্রথম আলো জবসের হেড অব অপারেশনস হোমায়রা শারমীন। সাধারণত দেশি ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলোর সব ধরনের আন্তযোগাযোগ ইংরেজিতে হয়ে থাকে। একেকটা প্রতিষ্ঠানে প্রচুর বিক্রয় প্রতিনিধি থাকেন, যঁারা চিকিৎসক এবং ওষুধবিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হোমায়রা বললেন, Èদেখা গেল বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে ওষুধ-সম্পর্কিত যে নির্দেশনা যাচ্ছে ইংরেজিতে তা তঁাদের অনেকেই পুরোপুরি বুঝতে পারছেন না। ফলে চিকিৎসকের সঙ্গেও তঁাদের যোগাযোগটা পূর্ণাঙ্গ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে তঁাদের যদি বাংলায় নির্দেশনা দেওয়া যেত, তবে পুরো বিষয়টি হূদয়ঙ্গম করে তঁারা কার্যকরভাবে চিকিৎসক বা ওষুধবিক্রেতাদের বোঝাতে পারতেন।‘
ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলায় যোগাযোগ করলে কি কার্যক্ষমতা বা দক্ষতার কমতি হবে? হোমায়রার উত্তর, Èমোটেই না।‘