ব্যবসা ও অর্থনীতিডেস্ক(২০ ফেব্রুয়ারী): টেরিটাওয়েল (তোয়ালেজাতীয় পণ্য) উৎপাদক বিসমিল্লাহ গ্রুপ দেশের পাঁচটি ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অর্থ হাতাতে হল-মার্কের মতোই কৌশল নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও নতুন ফন্দিফিকির। ব্যাংক খাতে এই নতুন কেলেঙ্কারির আলোচনা এখন সর্বত্রই।
বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হচ্ছেন খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী।চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী নওরীন হাসিব। তাঁরা দুজনই এখন দেশের বাইরে।ব্যাংকিং সূত্রগুলো বলছে, প্রায় ১১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছেন গ্রুপটির মালিকেরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জালিয়াতিতে বিসমিল্লাহর যাত্রা অবশ্য শুরু হয়েছিল হল-মার্কের আরও আগে। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে টাকার অঙ্কে তারা হল-মার্ককে ছাড়াতে পারেনি। কিন্তু ভুয়া রপ্তানি দেখানো, বিদেশে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে তার মাধ্যমে অতিমূল্যায়ন করে বাংলাদেশ থেকে আমদানি এবং এর মাধ্যমে রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তা হাতিয়ে নেওয়ার মতো পন্থা তৈরি করে হল-মার্ক থেকে এগিয়ে গেছে বিসমিল্লাহ। এর পাশাপাশি হল-মার্কের মতোই নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের খোলা স্থানীয় এলসি (ঋণপত্র) দিয়ে আরেক (এটাও নিজস্ব) প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি নিয়ে বিল তৈরি করে (অ্যাকোমুডেশন বিল) তা ব্যাংকে জমার মাধ্যমে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে।
বিসমিল্লাহর লেনদেনের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলো থেকে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। এর মধ্যে একটি ব্যাংকের একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালকও রয়েছেন। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে এই ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা, বেসরকারি প্রাইম, শাহজালাল, প্রিমিয়ার, যমুনা ও সাউথইস্ট ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে অনিয়ম ও জালিয়াতির সব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। নতুন এই কেলেঙ্কারির ফলে ব্যাংক খাতের ওপর যাতে কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভেতরে ভেতরে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমন্বয়ও হয়েছে।
জালিয়াতির নানা কৌশল: বিসমিল্লাহ গ্রুপের অন্যতম দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিসমিল্লাহ টাওয়েলস ও আলফা কম্পোজিট টাওয়েলস। আলফা টাওয়েলস ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিল শাখা থেকে ৯২ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ৮২টি রপ্তানি বিলের বিপরীতে ২৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ঋণ নেয়। একইভাবে বিসমিল্লাহ টাওয়েলসের ২৭ মে থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত ৮৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকার ৬১টি রপ্তানি বিলের বিপরীতে প্রাইম ব্যাংক ২৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা ঋণ দেয়।
নিয়ম অনুসারে পণ্য জাহাজীকরণের পর ১২০ দিনের মধ্যে এই বিলের টাকা দেশে আসার কথা। কিন্তু তা দেশে প্রত্যাবাসন হয়ে আসেনি। সবগুলো রপ্তানিই হয়েছে এলসি (ঋণপত্র) নয়, চুক্তির (এক্সপোর্ট বা সেল কন্ট্রাক্ট) বিপরীতে। মজার ব্যাপার হলো, ক্রেতা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান সবগুলোর মালিকপক্ষ একই।বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, চুক্তিগুলোতে দেখা যায় সরবরাহকারী হিসেবে আলফা কম্পোজিট ও বিসমিল্লাহ টাওয়েলসের নাম রয়েছে। আর আমদানিকারক হিসেবে দুবাইয়ের ব্যাঙ্গলুজ মিডলইস্টের নাম আছে। সরবরাহকারী দুই কোম্পানির পক্ষে কোম্পানির চেয়ারম্যান নওরীন হাবীব স্বাক্ষর করেছেন।আর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে স্বাক্ষর থাকলেও নাম বা সিল দেওয়া নেই।ফলে সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এখানেই শেষ নয়।প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে হাতে এসেছে সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ের ব্যাঙ্গলুজের কিছু প্রমাণাদি। যাতে দেখা যাচ্ছে, খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।
বাংলাদেশ ব্যাংক এই ৫৫ কোটি ৪২ লাখ টাকার ঋণকে গুণগতমানে ক্ষতিজনক পর্যায়ে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে বলেছে প্রাইম ব্যাংককে।
আবার বিসমিল্লাহ টাওয়েলস ও আলফা কম্পোজিট টাওয়েলস প্রাইম ব্যাংক থেকে স্বীকৃত বিলের বিপরীতে ১৭৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকার ঋণ সৃষ্টি করে। নির্ধারিত সময়ে তা পরিশোধ না হওয়ায় পরে তা ফোর্ডস ঋণ তৈরি করে ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে ফোর্সড ঋণকে পরিশোধের অতিরিক্ত সময় দেওয়ায় এই পুরো অর্থই ক্ষতিজনক পর্যায়ে খেলাপি চিহ্নিত করতে বলেছে। এটা কেবল প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখার মাধ্যমে অর্থ জালিয়াতির তথ্য।
অন্যদিকে, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৬৪ কোটি ৮১ লাখ টাকার ৬৭টি রপ্তানি বিলের মূল্য দীর্ঘদিন ধরে পরিশোধ করা হয়নি। আবুধাবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে বিলগুলো সংরক্ষিত রয়েছে।আমদানিকারক গ্রাহক বিলগুলো সংগ্রহ না করায় ২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর আবুধাবি কমার্শিয়াল ব্যাংক চিঠি দিয়ে রপ্তানি ডকুমেন্টসমূহ (প্রমাণাদি) ব্যাংকের কাছে ফেরত পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলেছে, এখানে রপ্তানিকারক, আমদানিকারক ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার যোগসাজশে ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে রপ্তানির বিপরীতে (ফরেন ডকুমেন্ট বিল পারচেজ বা এফডিবিপি) ব্যাংক থেকে এই অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ঋণের মধ্য থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংককে ৫৯ কোটি ২১ টাকার ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে নির্দেশ দিয়েছে।
বিভিন্ন ব্যাংকে দায়দেনা ও শাস্তি: বিসমিল্লাহ গ্রুপ এভাবে নানা ফন্দিফিকির করে জনতা ব্যাংক থেকে মোট (ফান্ডেড বা ঋণ ও নন ফান্ডেড বা গ্যারান্টি জাতীয়) ঋণ সৃষ্টি করেছে ৩৯২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, প্রাইম ব্যাংকে এক শাখাতেই ৩০৬ কোটি ২২ লাখ টাকা, যমুনা ব্যাংকে ১৬৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, শাহজালাল ব্যাংকে ১৪৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ও প্রিমিয়ার ব্যাংকে ৬২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এই সব জালিয়াতির কারণে যমুনা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হোসেন ও দিলকুশার শাখা ব্যবস্থাপককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রিমিয়ার ব্যাংকের মতিঝিল শাখার ব্যবস্থাপককে বরখাস্ত করে প্রধান কার্যালয়ে কয়েক দিন আটকে রাখা হয়। পরে ফৌজদারি মামলা করে তাঁকে থানায় হস্তান্তর করা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রধান কার্যালয়ের যথাযথ পর্যালোচনা ও যাচাই ছাড়াই এই ঋণের অনুমোদন হয়। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২০১১ সালে ১৩ নভেম্বর আলফা কম্পোজিটের অনুকূলে ২২ কোটি টাকার ঋণসীমা অনুমোদনও করে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের তদারকি ও মনিটরিংয়ের ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। প্রাইম ব্যাংক, জনতা ও শাহজালাল ব্যাংকে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে যমুনা ব্যাংকের সদ্য যোগ দেওয়া এমডি শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলছি। কীভাবে টাকাটা আদায় করা যায় তা সম্মিলিতভাবেই করণীয় ঠিক করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, তাঁরা শুনেছেন দুবাইতে সোলেমান চৌধুরী হোটেল ব্যবসা করছেন। তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।
জনতা ব্যাংকের এমডি এস এম আমিনুর রহমান বলেন, তাদের হিন্দুল ওয়ালি টেক্সটাইল মিল ও আলফা কম্পোজিট মিলে ঋণ আছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানেরই রপ্তানি কার্যক্রম চলছে। তবে প্রত্যাবাসনে কিছুটা ধীরগতি আছে। উল্লেখ্য, হিন্দুল ওয়ালিও বিসমিল্লাহর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।
আর প্রিমিয়ার ব্যাংকের এমডি মাজেদুর রহমান বলেন, অর্থ আদায়ের বিষয়টি এখন পুরো আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে গেছে।
মেজর (অব.) মোহাম্মদ আলী বিসমিল্লাহ গ্রুপের পরিচালক ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিন মাস আগে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি থাকাকালে নানা ধরনের জালিয়াতি হয়েছে—এমন প্রশ্নে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমি প্রশাসন দেখতাম। আর ব্যবসায়িক দিকগুলো প্রতিষ্ঠানের এমডি দেখতেন।’
মাস দুয়েক আগে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন বিসমিল্লাহ গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকবর মুত্তাকি। যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এখন বেশির ভাগ কর্মকর্তারাই চাকরি থেকে সরে যাচ্ছেন ও গেছেন। উৎপাদন প্রক্রিয়া ঠিক আছে কি না সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু হয়তো হয়। আর মালিকপক্ষ দেশে আসবে কি না প্রশ্নে জবাব মেলে বলা কঠিন, বোধ হয় না।
অন্যদিকে কয়েক দফা চেষ্টার পর প্রাইম ব্যাংকের এমডি এহসান খসরুর সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু তিনি খেলার মাঠে রয়েছেন এবং তখন কিছু শুনতে চান না বলে ফোনটি কেটে দেন। ফলে বিষয়বস্তুও তাঁকে জানানো যায়নি।
নিউজরুম্