১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: একুশের বইমেলা মানেই লেখক-পাঠকের প্রাণের উৎসব। আর এ উৎসবে প্রতি বছর শামিল হন অনেক নারী লেখক-পাঠক। তাদের নিয়েই এবারের লেখাটি তৈরি করেছেন ফাতেমা মাহফুজ কুমকুম বাবার হাত ধরে মেলায় এসেছে ছোট মেয়ে তাহমিনা। স্টলে টুনটুনির বই দেখতেই আনন্দিত হয়েÑ ‘বাবা, ওই যে টুনটুনি! আমি টুনটুনির বই নেবো’। মেয়ের আবদার, টুনটুনির বইটা নিয়ে উল্টিয়ে দেখছেন তাহমিনার বাবা। মেলায় মাত্র এসেছেন, এখনো কোনো বই কেনা হয়নি। ভেবেচিন্তে একটা সুন্দর বই উপহার দেবেন তাহমিনাকে। ছোট কী বড় সবাই আজ বইপ্রেমী।উৎসুক মনে নিজের চাহিদামতো বই কিনছেন। এ দিকে বান্ধবীদের সাথে এসেছেন এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থী জেসমিন আরা। পছন্দ করেন গল্প, উপন্যাস।কিনেছেন লেখক ইমদাদুল হক মিলনের কাননে কাননকলি। নিজের অনুভূতি জানিয়ে বলেন, ‘আগে কখনো আসা হয়নি। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর এই প্রথম মেলায় আসি। খুব ভালো লাগছে।’ এ দিকে উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের জান্নাত। তিনি বলেন, ‘সব সময়ই আসি। অনেক ভালো লাগে। আর বিশেষ করে সমরেশ মজুমদারের বই বেশি পছন্দ।’ কথা হয় অনুবাদকৃত বইয়ের খোঁজে আসা শিকিা নাহহিন সুলতানার সাথে। নিজের কাক্সিত বই পেয়ে তিনি সন্তুষ্ট। অনুভূতি জানিয়ে বলেন, ‘আমি মূলত বইমেলায় আসি অনুবাদ করা বইগুলো কিনতে। সেই সাথে হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবালের বইও পছন্দ।’
বইমেলায় নারী লেখক
এ তো গেল নারী পাঠিকাদের অনুভূতির কথা। আসি নারী লেখক প্রসঙ্গে। বইমেলায় এসেছে নারী লেখকদের প্রচুর বই। সম্মানিত লেখকরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো ফুটে তুলেছেন বিভিন্নভাবে। কেউ কবিতার মাধ্যমে, তো কেউ উপন্যাসে, কেউ বা ছোটগল্পের মাধ্যমে। এ দিকে বিভিন্ন শিশুতোষ গল্পের স্টলেও দেখা গেছে নারী লেখকদের বইসামগ্রী। কথা হয় মুক্তিযোদ্ধার কন্যা ও স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত লেখক জাহানারা জানির সাথে। প্রচারবিমুখ ও সদালাপি এই লেখক লিখে যাচ্ছেন সেই ছোটবেলা থেকেই। লেখক হওয়ার পেছনের ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সেই ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শখ, মুক্তিযুদ্ধের পর পরিবারে অনেক অভাব ছিল। তবে সে সময় কবি নজরুলের কবিতাগুলো আমাকে মুগ্ধ করে, আমি নিজে থেকেই চিন্তা করি আমাদের নজরুল এত কষ্টের মধ্যে থেকে এত সুন্দর করে এক কাব্যিক ছন্দে লিখে যান, তাহলে আমি পারব না কেন? এমনই এক অনুভূতি ও কবি হওয়ার প্রবল ইচ্ছা আমাকে এই পথে উৎসাহ জুগিয়েছে।’ এবারের বইমেলায় বের হয়েছে উনার দু’টি বই।মুক্তচিন্তা প্রকাশনী থেকে ‘একটি বাংলাদেশ ছোটদের মজার ছড়া’ ও ‘নীল পরী ও আরশি মনি’। জাহানারা জানি শুধু ছোটদের জন্য নয় বরং ইতিহাস, সায়েন্সফিনশন, গল্পÑ এসব নিয়েও অনেক বই লিখেছেন। এ দিকে তার স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থ ‘ইতিহাসের রিমোট কান্ট্রোল’ এর ব্যাপারে তিনি বলেন,‘সেই ২০০০ সালের কথা। আমার এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। বইটিতে আমি একপীয় নয় বরং ইতিহাসের মূল ধারণাকে কাব্যিক ছন্দে সবার মাঝে ফুটিয়ে তুলেছি। যার ফলে বইটি এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, ২০০৭ সালে এই বইটির জন্য স্বর্ণপদক অর্জন করি।’ পাঠকপ্রিয়তার ব্যাপারে জিজ্ঞাস করায় লেখিকা বলেন, ‘আমি মনে করি, মানুষের চেহারা নয় বরং কর্মই তার পরিচয় ফুটিয়ে তোলে। আর তাই আমি সামনে মিডিয়া দেখলেও এগিয়ে যাই না। আমার পাঠকেরাই আমাকে মনে রাখে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার সেই ২০০৭ সালের বই এখনো জনপ্রিয়। আল্লাহর রহমতে আমার পাঠক সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। পাঠকের সন্তুষ্টিই আমাকে সন্তুষ্ট করে। এ দিকে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে বের হওয়া কবিতার বই ‘নিসর্গ’র তরুণ লেখিকা সৈয়দা আফিয়াত হাসিন নিজের অনুভূতি জানিয়ে বলেন, ‘নিজের লেখা প্রথম বই বের হলো এটা ভেবেই আনন্দিত। ছোট ছোট ছড়া-কবিতা নিয়ে আমার এই বই। প্রথমে বই আকারে বের করার ইচ্ছা ছিল না, তবে আব্বুর অনুপ্রেরণায় এ পর্যন্ত চলে আসা।’ জনপ্রিয়তা কেমন জানতে চাওয়ায় বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট’।
বইমেলায় প্রকাশিত
নারী লেখকদের বই
পিপিএমসি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘আমার দেশের গল্প পড়ি’ লিখেছেন জুবাইদা গুলশান আরা হেনা। বিদেশী কার্টুন আর গল্পের ভিড়ে আজকাল শিশুরা যেন নিজ দেশের শিশুতোষ গল্পের সাথে পরিচিত হতে পারছে না। তাই ছোটদের জন্য বেশ কিছু গল্পের বই লিখেছেন জুবাইদা গুলশান আরা। এ দিকে মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সাগুলোকে গল্পাকারে ফুটিয়ে তুলেছেন সাহিত্য পদকপ্রাপ্ত লেখিকা সুলতানা সাঈদা বেগম তার ‘সুখের বিবর্তন’ বইটিতে। বইটি নন্দিনী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। চারপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা ও নিজের অনুভূতিকে কবিতার মাধ্যমে উপজীব্য করে তুলেছেন আমেরিকা প্রবাসী লেখিকা রুমানা গণি তার ‘হৃদয়ের অনন্ত অম্বরে’ নামক কবিতার বইটিতে। ‘একটি প্রশ্নবিদ্ধ জন্ম’ লিখেছেন ম্যারিনা নাসরীন।লেখিকা ম্যারিনা অনেক দিন ধরেই দৈনিক পত্রিকা, ব্লগ ও বিভিন্ন অনলাইনে লিখেন। এ বইটিতে তিনি নারীর অসহায়ত্ব, অনাচার, অনাকাক্সিত বিষয় এবং পঙ্কিলতার মাঝে নিমজ্জিত বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলেছেন।
প্রতিদিনই শুরু হয় এক প্রত্যাশা নিয়ে। সেই সাথে প্রকৃতির খেলা যেন আমাদের জীবনকে এক অন্য দিগন্তে নিয়ে যায়। পথি মাঝে আঁকাবাঁকা পথ চলা আর নানা ণের এলোমেলো ভাবনা নিয়েই সাজানো ‘একটি সকালের প্রতীায়’ বইটি লিখেছেন মোনোয়ারা মণি।ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত সেলিনা হোসেনের ‘ভাষা মুক্তিযুদ্ধ সাহিত্য সংস্কৃতি’। লেখিকা সেলিনা হোসেনের আরেকটি উপন্যাসের বইÑ ‘মর্গের নীল পাখি’, যা রচিত হয়েছে একদল ছেলেমেয়ের মর্গ নিয়ে অভিজ্ঞতার আলোকে।যেসব শিশুরা নিজেদেরকে এই মর্গেই ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে। তারা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়ে বলে, রাষ্ট্র যেন নিজেই বেওয়ারিশ লাশ বহনকারী আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের গাড়ি। এ দিকে আধুনিক কবি সানজিরা সেতু, তার কাব্যগ্রন্থ ‘নীল খামে স্বপ্ন ঠিকানা’তে ফুল-পাখি, জোছনাÑ এগুলোর গল্প বলতে ছন্দকে সাথে নিয়ে প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছে বর্ষাদুপুর প্রকাশনী থেকে।
প্রকাশকের কথা
দেশীয় সংস্কৃতির আলোকে ছোট শিশুদের মানসিক বিকাশের ল্যকে সামনে রেখে পিপিএমসি প্রকাশনী পসরা সাজিয়ে বসেছেন ছোটদের রূপকথা ও দেশীয় গল্পের বই নিয়ে। আর বেশির ভাগ শিশুতোষ গল্পের লেখক মূলত নারী। এ দিকে বই বিক্রি প্রসঙ্গে এক প্রকাশক বলেন, ‘বইগুলো বেশ চমৎকার, তবে শাহবাগের আন্দোলন অনেকের মনে ভয়ের সৃষ্টি করায় অনেক মা-বাবা তাদের ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই দিকটায় আসতে চাচ্ছেন না।ভয় পাচ্ছেন, তাই বিক্রি কম হচ্ছে।’ তবে স্টলগুলোতে দেশীয় কার্টুন, রূপকথা ও ছোটদের গল্পের বাহারি বই ছিল চোখে পড়ার মতো। এ দিকে আহমদ প্রকাশনী আপে করেই বলে, ‘ফুটপাথে অবাধে কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করে ভারতীয় বইসহ বিভিন্ন বই বেআইনিভাবে বিক্রি হচ্ছে। এতে দেশীয় প্রকাশনী তির সম্মুখীন হচ্ছে। এ দিকে কর্তব্যরত পুলিশদের নালিশ দেয়ায় কিছু সময়ের জন্য ফুটপাথের খোলা দোকানগুলো উঠে গিয়েছিল, তবে আবার সেই একই চিত্র।’ এ দিকে নারী লেখকদের বই কেমন বিক্রি হচ্ছে জানতে চাওয়ায় প্রকাশকেরা সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেন।