ব্যবসা ও অর্থনীতিডেস্ক(১৯ ফেব্রুয়ারী): বাংলাদেশ-ভারত গ্রিড আন্তঃসংযোগ প্রকল্পের সমাপ্তি নিয়ে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। আড়াই বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩১.০৮ শতাংশ। একনেক সভায় অনুমোদনের ছয় মাস আগেই দরপত্র আহ্বান করেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকার প্রকল্পটি শেষ করতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো এখন প্রকল্প ব্যয় ৫০১ কোটি ১৪ লাখ টাকা বা ৪৬.৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং সময় বাড়ানো হয়েছে দুই বছর। প্রকল্পটি এখন ২০১৪ সলের জুনে শেষ করা হবে বলা হলেও এই বর্ধিত সময়েও প্রকল্প শেষ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধিতে কমিশন থেকে আপত্তিও জানানো হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন না করেই ইতোমধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। আবার কাজও করা হয়েছে অনেকখানি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন গ্রিড ইন্টারন্যাশনাল বিটুইন বাংলাদেশ (ভেড়ামারা) অ্যান্ড ইন্ডিয়া (বহরমপুর) প্রজেক্টটি ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু সময় মতো কাজ শেষ করতে না পারায় ব্যয় ঠিক রেখেই প্রথমবার ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু এবার বিভিন্ন অংশের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে সংশোধনের প্রস্তাব করা হয় পরিকল্পনা কমিশনে। সেই সাথে বাস্তবায়নের সময়ও বাড়ানোর কথা বলা হয় ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পটির মূল ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৭৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ছিল সরকারি তহবিলের ২৭৭ কোটি ২৪ লাখ, বাস্তবায়নকারী সংস্থার ১০১ কোটি ৪৫ লাখ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু সেই ব্যয় ৫০১ কোটি ১৪ লাখ টাকা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে এক হাজার ৫৭৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকারি তহবিলের অংশে বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন অংশের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। যেমন এক হাজার ৫০০ বর্গমিটার ভবন নির্মাণে মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল চার কোটি পাঁচ লাখ টাকা। সেখানে প্রস্তাবে ৫০০ বর্গমিটার বাড়িয়ে এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এক হাজার ২০০ মিটার অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণে অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৩৬ লাখ টাকা, সেখানে রাস্তা কমিয়ে ৩১০ মিটার করা হলেও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ২৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। দুই হাজার ৬২৫ রানিং মিটার সীমানা প্রাচীর নির্মাণে আগের ব্যয় ছিল এক কোটি ৩১ লাখ টাকা। বর্তমানে প্রাচীরের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে তিন হাজার ৩০০ মিটার করে ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা।
এ ছাড়া এক হাজার মিটার সারফেস ড্রেন নির্মাণে আগে ব্যয় ছিল ১৮ লাখ টাকা। এখন ওই একই দৈর্ঘ্যরে ড্রেন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ৭০০ মিটার ক্যাবল ট্রেন্স নির্মাণে ব্যয় ছিল ৩৩ লাখ, এখন সেটি বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে আট কোটি ৭৫ লাখ টাকা। দু’টি সেপটিক ট্যাংক সোয়াকওয়ে নির্মাণে ব্যয় ছিল তিন লাখ ২০ হাজার টাকা, বর্তমানে বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে দুই কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ইলেকট্রিফিকেশন অ্যান্ড বাউন্ডারি লাইটিংয়ের ব্যয় ছিল ২০ লাখ টাকা, সেখান থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে দুই কোটি চার লাখ টাকা। এ ছাড়া নতুন অংশ হিসেবে প্রস্তাব রয়েছে ফিনিসিং অ্যান্ড গেটস চার কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং ফায়ার ওয়ার্ক ওয়াল ফর কনভারটার ট্রান্সফরমারের জন্য দুই কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এসব অংশে মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল মোট ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সেখান থেকে বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ৬৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর গত ১০ জানুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অহেতুক ব্যয় বাড়ানো হয়েছে বলে মনে হওয়ায় ব্যাখ্যা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়।
সূত্র জানায়, এ প্রকল্পে আরো কিছু অনিয়ম খুঁজে পায় পরিকল্পনা কমিশন। স্পেয়ার পার্টস ক্রয়ে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছে। কিছু অত্যাবশ্যকীয় স্পেয়ার পার্টস যেমন রি-অ্যাক্টর ও বুসিং সার্কিট ব্রেকারের দামও বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের আগেই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। ট্রান্সমিশন লাইন ও সাবস্টেশন যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ব্যয় ছিল ৪৭৮ কোটি টাকা। সেটি বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ৭৪৮ কোটি টাকা। ডিপিপি সংশোধন না করেই ইতোমধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে গেছে। কাজও করা হয়েছে অনেকখানি। এসব অভিযোগ থাকলেও কী কারণে এ প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপনের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে তা নিয়েই দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য এর কাজকে দু’ভাগে বিভক্ত করে দু’টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। স্পেনের কোম্পানি এমএস কোবরা প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ পেয়েছে। বিষয়টি এডিবির অনুমোদন পেতে লেগেছে তিন মাস।আর কোবরার সাথে চুক্তি হওয়া পর্যন্তও সময় লেগেছে চার মাস। প্রকল্পটি শেষ হলে চুক্তি অনুযায়ী প্রথম বছরে ২৫০ মেগাওয়াট আর পরবর্তী সময়ে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে বাংলাদেশ।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলোÑ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যুৎ আদান-প্রদানের লক্ষ্যে গ্রিড আন্তঃসংযোগ নির্মাণ, যাতে উভয় দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে আর্থসামাজিক উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। প্রকল্পের আওতায় ভেড়ামারা (বাংলাদেশ)-বহরমপুর (ভারত) ৪০০ কেভি গ্রিড ইন্টারকানেকশন-৩০ কিলোমিটার এবং ভেড়ামারায় ঈশ্বরদী-খুলনা (দক্ষিণ) ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইনে লুপ-ইন-লুপ আউট-৫ কি.মি. সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ভেড়ামারায় ৫০০ মেগাওয়াট এইচভিডিসি ব্যাক টু ব্যাক ৪০০/২৩০ কেভি সুইচিং স্টেশন স্থাপন, ৫০০ মেগাওয়াট এইচভিডিসি ব্যাক টু ব্যাক (৪০০/২৩০ কেভি) টার্মিনাল স্থাপন, ঈশ্বরদী-খুলনা দক্ষিণ ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন থেকে লুপ ইন ও লুপ আউটের জন্য চারটি ২৩০ কেভি লাইন-বে নির্মাণ এবং ন্যূনতম দুইটি ২৩০ কেভি বে নির্মাণ করা হবে।
বিদ্যুৎসঙ্কটের কারণে বাংলাদেশ সরকার ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করে। তারই ধারাবাহিকতায় বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল আলোচনার জন্য গত ১৮ থেকে ২২ নভেম্বর ভারত সফর করে। আর গত ২২ থেকে ২৬ নভেম্বর ভারতের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে প্রকল্পসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় আলোচনা শেষে একটি মিনিটস অব মিটিং (এমওএম) এ স্বাক্ষর করে। ওই এমওএম অনুযায়ী প্রকল্পে উচ্চ বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রণয়নের লক্ষ্যে উভয় দেশের চারজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। কারিগরি কমিটি থেকে পাঠানো ডিপিআরের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য প্রকল্পটির ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়।
নিউজরুম্