ঢাকা: ১৯৭১ সালের ৬ জুন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযম। বৈঠকে গোলাম আযম মুক্তিযোদ্ধাদের তথাকথিত দেশপ্রেমিক ও দুষ্কৃতিকারী আখ্যা দিয়ে তাদের দমনে অস্ত্র সরবরাহের আবেদন জানান ইয়াহিয়ার কাছে। একই সঙ্গে তিনি সামরিক হস্তক্ষেপেরও দাবি জানান।
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনকালে এ কথা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষ। এর সপক্ষে তারা ১৯৭১ সালে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রের কাটিং ও বিভিন্ন ডকুমেন্ট উপস্থাপন করেন।
সোমবার দিনভর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। সকালে প্রথমার্ধ্বে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম। দুপুরে দ্বিতীয়ার্ধ্বে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অপর প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ সীমন। চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু এ সময় উপস্থিত ছিলেন। তবে আসামিপক্ষের কোনো সিনিয়র আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।
সোমবার দ্বিতীয় দিনে রাষ্ট্রপক্ষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক সংগ্রামের বিভিন্ন সংবাদের কাটিং এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে জব্দ করা বিভিন্ন ডকুমেন্ট প্রদর্শন করেন।
মঙ্গলবার পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন মুলতবি করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে রোববার গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করে প্রথম দিনে যুক্তিতর্কের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম।
গোলাম আযমের মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া বর্তমানে শেষ ধাপে রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের পরে আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করলে আইন অনুসারে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করবেন ট্রাইব্যুনাল।
উল্লেখ্য, নির্ধারিত ১২ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন সাফাই সাক্ষীকে হাজির করে সাক্ষ্য দেওয়াতে পেরেছেন আসামিপক্ষ। একমাত্র সাফাই সাক্ষী গোলাম আযমের ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী গত বছরের ১২ নভেম্বর থেকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাফাই সাক্ষ্য দেন তার বাবার পক্ষে। রাষ্ট্রপক্ষ তার জেরা শেষ করেন ১১ ফেব্রুয়ারি।
অন্যদিকে তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে জব্দ তালিকার ৭ সাক্ষীসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৭ জন সাক্ষী এর আগে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামিপক্ষ তাদের জেরাও সম্পন্ন করেছেন। আর ১ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া জবানবন্দিকেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া ঘটনার সাক্ষীরা হলেন, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকারকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা দক্ষিণপাড়া গ্রামের সোনা মিয়া, একজন শহীদ পরিবারের নারী(ক্যামেরা ট্রায়াল), দেশবরেণ্য গীতিকার ও সুরকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, রাজধানীর নাখালপাড়ার ফরিদ আলম এবং মহসিন আলী খান।
আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন- বাংলা একাডেমীর সহ গ্রন্থাগারিক মো. এজাব উদ্দিন মিয়া, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) রাজনৈতিক শাখার উচ্চমান সহকারী সেলিনা আফরোজ, কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের উচ্চমান সহকারী কাজী আইয়ুব হোসেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার কামালের বোন ডা. মুনিয়া ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় যাদুঘরের কিপার ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত সাঁট মুদ্রাক্ষরিক জামিনুর শেখ।
মানবতাবিরোধী ৫ ধরনের অপরাধের ৬১টি অভিযোগে অভিযুক্ত করে গত বছরের ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ১০ জুন তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। ১ জুলাই থেকে শুরু হয় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ হলো, মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, উস্কানি, পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করা এবং হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেওয়া।
অভিযোগগুলোর মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা ও তাদের সঙ্গে চক্রান্ত করার জন্য ছয়টি, তাদের সঙ্গে পরিকল্পনার তিনটি এবং উস্কানি দেওয়ার ২৮টি এবং তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ২৪টি অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়।
পরে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কারাগারে পাঠানোর পর চিকিৎসার জন্য তাকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার বিচার চলছে।
এর আগে গত বছরের ৯ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের জমা দেওয়া ওই আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মোট ৬২টি অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ৬১টি গ্রহণ করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। পরে কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের মাধ্যম। মোট ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র সংযুক্ত করা হয়।
ফেব্রুয়ারি ১8, ২০১৩