ব্যবসা ও অর্থনীতিডেস্ক(১৭ ফেব্রুয়ারী): চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানি হয়েছে এক হাজার ৬০৬ কোটি ডলারের পণ্য। আগের বছরের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭২১ কোটি ডলার।অর্থাৎ আমদানি ব্যয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ কমেছে। আমদানি কমে যাওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়েছে মনে হলেও এ প্রবণতাকে অর্থনীতিবিদেরা দেখছেন শিল্পের জন্য অশনি সঙ্কেত হিসেবে। কারণ মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় আগামী দিনগুলোতে শিল্পোৎপাদন কমে যাবে, চাপের মুখে পড়বে অর্থনীতি।বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখতের মতে, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামালের আমদানি কমায় আমদানি ব্যয় কম হয়েছে। এর অর্থ দেশে বিনিয়োগ ও শিল্পোৎপাদন কম হচ্ছে।
বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকারের চতুর্থ বছরে এসে রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে তাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কোনোভাবেই আশাবাদী হতে পারছেন না। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে চলমান আন্দোলন, আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা এবং সর্বশেষ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে সৃষ্ট ধূম্রজাল কত দূর গড়ায় তা নিয়ে কোনো অনুমানই করতে পারছেন না তারা। এমনিই এক পরিস্থিতিতে নতুন করে বিনিয়োগের তো প্রশ্নই আসে না উল্টো ইতোমধ্যে বিনিয়োগকৃত অর্থ ফিরে আসবে এমন নিশ্চয়তা মিলছে না কোনো পক্ষ থেকেই।মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার এটিই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি সরকারের মনোযোগের অভাবে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ১০ কর্মঘণ্টার সাত ঘণ্টাই বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের। দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাসের চাপ থাকে না। এ সময় কারখানা চলছে জেনারেটরের সাহায্যে। বিদ্যুতের পরিবর্তে ডিজেল কিংবা ফার্নেস অয়েল দিয়ে জেনারেটরের সাহায্যে কারখানা চালু রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এতে করে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। স্বাভাবিক কারণেই বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা হারাচ্ছেন বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক ছোটখাটো কারখানা। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে চড়া সুদে। এসব কারণেই রফতানির প্রবৃদ্ধি আগের বছরের ৪৩ শতাংশের পরিবর্তে সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে মাত্র ছয় শতাংশে নেমে এসেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বাধ্য হয়ে অনেক বিদেশী, যৌথ বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এবং ক্ষেত্রবিশেষে দেশী উদ্যোক্তারাও নিজেদের কারখানা সরিয়ে নিচ্ছেন অন্য দেশে।
জেনেভাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের (আইআইএসডি) বিনিয়োগ চুক্তি বিশেষজ্ঞ বার্নাসকনি অস্টারওয়াল্ডার সম্প্রতি ঢাকায় দ্বিপীয় বিনিয়োগ চুক্তি, দরকষাকষি এবং বিরোধ নিষ্পত্তি শীর্ষক এক কর্মশালায় বলেছেন, উর্বর জমি, বিপুল জনগোষ্ঠী এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগের জন্য খুবই আকর্ষণীয় স্থান। কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব এবং সরকার ও বিনিয়োগ বোর্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অযোগ্যতার কারণে কাক্সিত হারে বিদেশী বিনিয়োগ আসছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, টেকসই আইনি কাঠামো এবং উদ্যোক্তাবান্ধব নীতিমালায় আকৃষ্ট হয়ে বিনিয়োগ গন্তব্য নির্ধারণ করে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হলে বাংলাদেশ দ্রুত দণি এশিয়ায় বিনিয়োগের তীর্থস্থানে পরিণত হতে পারে।
সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব টেক্সটাইল সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৮ সালে আট লাখ টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া বাংলাদেশী তৈরী পোশাক শিল্পের রফতানি বর্তমানে ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ৪০ হাজার থেকে বেড়ে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৫ লাখ লোকের। ৪০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এ শিল্প খাত জিডিপিতে ১৪ শতাংশ অবদান রাখছে। আগের অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৬৭৬ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের মধ্যে ৫৩৬ কোটি টাকাই এসেছে পোশাক শিল্প খাত থেকে। গত বছর প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর পাঁচ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা মুনাফার তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকাই এ খাতের অবদান। পরিবহন খাতকে গার্মেন্ট শিল্প দেয় বছরে ৫২০ কোটি টাকা, প্রিন্টিং সামগ্রী ব্যবহৃত হয় পাঁচ হ্জাার কোটি টাকার বেশি। শুধু তাই নয়, গার্মেন্ট শিল্পে কর্মরত ৩০ লাখ নারী শ্রমিক প্রতি বছর অন্তত ২০০ কোটি টাকার কসমেটিকস ব্যবহার করছে। কিন্তু সরকারের উদাসীনতার কারণে সম্ভাবনাময় এ শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
রফতানিমুখী শিল্প খাতের চলমান দুরবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং বর্তমান এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী নয়া দিগন্তকে বলেন, কেবল চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুৎ না পাওয়ায় বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করতে গিয়ে পোশাক শিল্প খাতে বার্ষিক তি হয় এক হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে লিডটাইমজনিত লোকসান। গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় দেশের স্টকলট হচ্ছে প্রতিনিয়তই। তড়িঘড়ি করে চার গুণ ভাড়া দিয়ে জাহাজের পরিবর্তে বিমানের কার্গো ভাড়া করে পণ্য পাঠাতে গিয়ে বছরে ক্ষতি হচ্ছে আরো দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে কেবল গ্যাস-বিদ্যুতের কারণে দেশের বার্ষিক লোকসান চার হাজার কোটি টাকার বেশি।পোশাক শিল্প খাত বর্তমানে একটি ক্রান্তিলগ্ন পার করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক দিকে স্থানীয় পর্যায়ে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, অন্য দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জিএসপিসহ নানা সঙ্কটে পণ্যের দ্রুত দরপতন হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা সমতাও দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ব্যাংকঋণের সুদহার অস্বাভাবিক বেশি।এমতাবস্থায় নতুন করে ব্যবসায় সম্প্রসারণের সুযোগ তো নেইই, বিদ্যমান কারখানাগুলো চালু রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। অনেক উদ্যোক্তা বাধ্য হয়ে কম্বোডিয়া-ভিয়েতনামে কারখানা সরিয়ে নিচ্ছেন বলেও জানান দেশের অন্যতম সফল এই উদ্যোক্তা।
এফবিসিসিআই, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার, ঢাকা চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বার, চট্টগ্রাম চেম্বারসহ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষস্থানীয় সাতটি সংগঠনের সভাপতি সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তৈরী পোশাকের বিদেশী ক্রেতারা তাদের অর্ডারগুলো অন্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছেন এবং ভোক্তারা বাংলাদেশী পণ্য বর্জন করতে শুরু করেছেন। দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানান তারা। বিবৃতিতে তারা বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সবার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এ মুহূর্তে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। দেশের ব্যবসায়ীসমাজ ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলকে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে সরে আসার আহ্বান জানাচ্ছে।পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমাদের রফতানি বাজার যেসব দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজমান সে দেশগুলোতে চলে যাবে উল্লেখ করে তারা বলেন, যেকোনো মূল্যে এ অবস্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
দেশের ব্যবসায়ীসমাজ মনে করে, রাজনৈতিক মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা সমুন্নত রাখার কোনো বিকল্প নেই।ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, গণতান্ত্রিক ধারাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।রাজনৈতিক মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীসমাজ মনে করে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো গণবান্ধব ও ব্যবসায়বান্ধব করা সম্ভব যদি ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল আরো সহনশীলতা প্রদর্শন করে এবং তাদের মতানৈক্য নিরসনে আলোচনার পথ বেছে নেয়। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে এমন সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিরত থেকে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তারা।
বিবৃতিতে তারা বলেন, বিশ্বস্ত সূত্রে ব্যবসায়ীসমাজ জানতে পেরেছে, দেশে বিরাজমান অস্থিরতার কারণে উত্তর আমেরিকার তৈরী পোশাকের বিদেশী ক্রেতারা তাদের অর্ডার অন্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছে এবং একদল ভোক্তা বাংলাদেশী পণ্য বর্জন করছে।এমতাবস্থায় সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি আমাদের আবেদন তারা যেন সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে। আর এটাই আমাদের দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবে।
নিউজরুম্