মুগের আবাদ বেড়েছে

0
136
Print Friendly, PDF & Email

কৃষি ডেস্ক(১৬ ফেব্রুয়ারী): দেশে ৬ লাখ হেক্টর জমিতে ৫ লাখ টন ডাল উত্পাদিত হয়, যা আমাদের চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ মাত্রবিভিন্ন দানাজাতীয় ফসলের চাষাবাদ বৃদ্ধির কারণে প্রতি বছর দেশে ডাল উত্পাদন কমছেবাড়ছে ডালের চাহিদাতবে আশার কথা হচ্ছে, বিগত কয়েক বছরে অন্য ডালের আবাদ কমলেও কিন্তু মুগের আবাদ বেড়েছেএর কারণ মুগই একমাত্র ফসল যা শীতকালীন ফসল কাটার পর চাষ করা যায়কিন্তু অন্য ডাল ফসল শুধু শীতকালেই চাষ করতে হয়শীতকালে বৃহত্তর পরিসরে ধান ও শাকসবজির চাষাবাদের কারণে ডাল ফসলের আবাদের সুযোগ কমে যাচ্ছেঅপরদিকে, একমাত্র মুগ ডালই শীতকালীন ফসল কাটার পর চাষ করা যায়এসব বিবেচনায় মুগই একমাত্র সম্ভাবনাময় ফসল যার আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভবএ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় আবিষ্কার করেছে স্বল্পমেয়াদি মুগ ডাল যা ৬০-৭০ দিনেই পাকেপরে দুটি ফসলের আবাদের মাঝে থাকা সময়ে এ ফসল চাষ করা যায়রবি ফসল যেমন- সরিষা, মসুর, গম, আলু ও শাকসবজি ইত্যাদি সংগ্রহের পর আমন ধান রোপণের আগ পর্যন্ত অধিকাংশ জমিই পতিত থাকেএ ধরনের পতিত জমিতে অতি সহজেই মুগ চাষ করে আবার সময়মতো রোপা আমন ধানও চাষ করা যায়এখানে গ্রীষ্মকালীন মুগের চাষাবাদ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো
মাটি ও জলবায়ু : পানি জমে থাকে না এ রকম সব ধরনের মাটিতেই মুগ ডালের আবাদ করা যায়তবে নিষ্কাশিত দো-আঁঁশ মাটিতে এ ফসল ভালো জন্মেমুগ চাষের জন্য উত্তম তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সে.তবে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ২০-২২ ডিগ্রি সে. এবং ভালো ফলনের জন্য কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রা হলো ২৬-৩২ ডিগ্রি সে.এ ফসলকে কিছুটা খরা সহিষ্ণু ফসল বলা হয়ে থাকেমুগ ডাল উজ্জ্বল রোদ এবং অপেক্ষাকৃত কম আর্দ্রতাপূর্ণ পরিবেশে ভালো জন্মেঅতিরিক্ত বৃষ্টিপাত মুগ ডাল সহ্য করতে পারে নাতাই মুগ ডাল এমন সময় বপণ করতে হবে যাতে বর্ষা শুরুর আগেই ফসল ঘরে তোলা যায়আবার মাটিতে আর্দ্রতার পরিমাণ খুব কমে গেলে গাছের বৃদ্ধিও ব্যাহত হয় এবং ফুল ও ফল কম হয়ে থাকে
জাত : বারিমুগ-২, বারিমুগ-৩, বারিমুগ-৪, বারিমুগ-৫, বিনামুগ-৬, বিনামুগ-৭, বিইউমুগ-১ এবং বিইউমুগ-২ জাতগুলো গ্রীষ্মকালে আবাদ করা যায়এদের মধ্যে বারিমুগ-৫, বারিমুগ-৬, বিনামুগ-৫, বিনামুগ-৬ এবং বিনামুগ-৭ আবাদে লাভ বেশি
বপনের সময় : গ্রীষ্মকালীন মুগ বপনের সময় অঞ্চলভেদে কিছুটা তারতম্য হয়দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের (বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগ) জেলাগুলো মাঘ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বীজ বপন করতে হবেতবে দেশের অন্য অঞ্চলে ফাল্গুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চৈত্রের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বীজ বপন করতে হবেফাল্গুন মাসের পর বীজ বপন করলে ফলন হ্রাস পায়এছাড়া গমের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করলে গম কাটার ১৫-২০ দিন আগে গমের জমিতে এ ফসল বপন করতে হয়তবে বপনের আগে অবশ্যই গমের জমিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকতে হবেযদি জমি পর্যাপ্ত আর্দ্র না থাকে তাহলে সেচ দিয়ে মুগের বীজ ছিটাতে হবে
সতর্কতা : আষাঢ় মাসে অবিরাম বৃষ্টিতে মুগের ফল পচে যায় এবং ফুল ও ফল কম হয়চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে জমিতে বীজ বপন সম্পন্ন করতে পারলে আষাঢ় মাসের আগেই ফসল সংগ্রহ করা যায় এবং ফল পচনের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়তাছাড়া ফাল্গুন মাসের আগে বীজ বপন করলে শীতের কারণে চারা মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে
জমি তৈরি : বপন ও মাটির প্রকারভেদের ওপর জমি তৈরি নির্ভর করে থাকেজমির অবস্থাভেদে ২-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবেশীতকালীন ফসল তোলার পর মুগ চাষের জন্য জমিতে ১-২টি চাষই যথেষ্টতবে পতিত জমির জন্য ৩-৪টি চাষ লাগেদানাজাতীয় ফসলের সঙ্গে আন্তঃফসল হিসেবে এর চাষ করা হলে জমি দানাজাতীয় ফসলের জন্য তৈরি করলেই চলেজমিতে পানির অভাব হলে বীজের অঙ্কুরোদগমের সুবিধার জন্য হালকা সেচ দেয়া প্রয়োজন
সার প্রয়োগ : দানাজাতীয় ফসল ধান ও গমের তুলনায় মুগ ডালে সার অনেক কম লাগেজমির ঊর্বতার ওপর নির্ভর করে সারের তারতম্য করা যেতে পারেএ ক্ষেত্রে স্থানীয় সার সুপারিশমালা অনুসরণ করতে হবেতবে সাধারণভাবে একরে ১২-১৫ কেজি ইউরিয়া, ২৮-৩০ কেজি টিএসপি, ১৫-২০ কেজি এমপি ও ৫ কেজি জিপসাম সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা যেতে পারে
বপন পদ্ধতি : বাংলাদেশে মুগ সাধারণত একক ফসল হিসেবে চাষ করা হয় তবে আন্তঃমিশ্র বা সাথী ফসল হিসেবেও চাষ করা হয়ে থাকেএ দেশে একক ফসল হিসেবে এর বপন পদ্ধতি দুধরনেরতা হলো ছিটানো ও সারি করেমুগ কালাই সাধারণত ছিটিয়ে বপন করা হয়বপনের পর ভালোভাবে মই দিয়ে বীজগুলো ঢেকে দিতে হয়তবে সারিতে বপন করলে ব্যবস্থাপনার সুবিধা হয় ও ফলন বেশি হয়এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ১০-১২ ইঞ্চি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৩-৪ ইঞ্চি হতে হবেসারিতে বীজ বপনের জন্য সিড ড্রিল ব্যবহার করলে সময় ও বীজ তুলনামূলকভাবে কম লাগে এবং গভীরতাও সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়মুগ কালাইয়ের বীজ বপন করার সময় খেয়াল রাখতে হবে বীজগুলো যাতে মাটির কিছুটা অভ্যন্তরে পৌঁছেএভাবে বীজ বপন করলে বীজের অপচয় কম হয় এবং অঙ্কুরোদগমও ভালো হয়
আগাছা দমন ও গাছ পাতলাকরণ : মুগের ভালো ফলন পেতে হলে ফসলের বৃদ্ধির প্রাথমিক অবস্থাতেই আগাছা দমন করতে হবেজমিতে আগাছা থাকলে ফসল গজানোর ২০-২৫ দিনের মধ্যে নিড়ানি দিয়ে আগাছা তুলে ফেলতে হবেআর একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে তা হলো জমিতে প্রয়োজনের তুলনায় কম/বেশি গাছ থাকলে উভয় ক্ষেত্রেই ফলন কম হয়তাই জমিতে পরিমিত পরিমাণ গাছ যাতে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবেগাছ ঘন থাকলে ফুল ও ফল কম হয় এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয়
রোগ ও পোকামাকড় দমন : মুগে যেসব রোগ হয় তাদের মধ্যে হলুদ মোজাইক ভাইরাস, পাতার দাগ ও পাউডারি মিলডিউ বেশি ক্ষতিকারকহলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগে আক্রান্ত গাছ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবেসাদা মাছি নামক এক ধরনের পোকার মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়তাই এ পোকা দমনে অনুমোদিত মাত্রার কীটনাশক নিয়মিত স্প্রে করতে হবেপাতায় দাগ রোগের আক্রমণ হলে অনুমোদিত রোগনাশক ১০-১২ দিন পর পর দুবার স্প্রে করতে হবেপাউডারি মিলডিউ রোগ হলেও যে কোনো অনুমোদিত রোগনাশক ১০-১২ দিন পর পর দুবার স্প্রে করতে হবেমুগে যেসব পোকার আক্রমণ হয় তার মধ্যে বিছাপোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা এবং থ্রিপস বেশি ক্ষতিকারকবিছাপোকার আক্রমণ হলে গাছের পাতার নিচের দিকে ডিম পাড়া অবস্থায় অথবা ডিম থেকে শুঁককীট বের হয়ে চলাচল শুরু করার আগেই আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পা দিয়ে চেপে মেরে ফেলতে হবেকীটনাশক দ্বারা দমন করতে চাইলে তা ব্যবহার করা যেতে পারেফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারেথ্রিপস পোকার আক্রমণ হলেও কীটনাশক ছিটিয়ে এ পোকা দমন করা যায়
ফল সংগ্রহ ও গাছের যত্ন : মুগের ফল একসঙ্গে পাকে না বিধায় ২-৩ বার সংগ্রহ করতে হয়প্রথমবার ফল সংগ্রহের পরে বিঘাপ্রতি ৪-৫ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিলে দ্বিতীয় সংগ্রহে ফলন বেশি পাওয়া যায়তবে ইউরিয়া সার দেয়ার শর্ত হলো জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকতে হবেযদি মাটিতে রসের অভাব থাকে তাহলে হালকা সেচ দিয়ে তারপর ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবেএভাবে তিনবার পর্যন্ত মুগ সংগ্রহ করা যায়মুগ সংগ্রহের পর গাছ উপড়ে তুলে ঘরে আনা যায় অথবা জমিতে চাষ দিয়ে মুগের গাছ মিশিয়ে দিলে প্রচুর পরিমাণ জৈব সার পাওয়া যায়, যা মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ : মুগের শুঁটি বাদামি বা কালচে রঙ হলে বুঝতে হবে মুগ পরিপকস্ফ হয়েছেতখন পরিষ্কার সূর্যালোকের সময় মুগের ফল সংগ্রহ করে শুষ্ক ও পরিষ্কার স্থানে রোদে শুকিয়ে তা মাড়াই করতে হবেএরপর বীজগুলো পারিষ্কার করে এবং ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে মাটি বা টিনের পাত্রে মুখ বন্ধ করে সংরক্ষণ করা হলে অনেকদিন পর্যন্ত বীজ ভালো থাকে

 

নিউজরুম

 

শেয়ার করুন