১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩।।
পরীক্ষায় নকল করতে না দেয়ায় গত সোমবার রাজধানীর উপকণ্ঠে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এক স্কুলশিক্ষককে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ উপজেলার চুনকুটিয়া গার্লস স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়াকে সকালে তার বাসায় ঢুকে সবার সামনেই খুন করেছে রিয়াদ হোসেন নামে এসএসসি পরীক্ষার্থী। স্থানীয় ওরিয়েন্ট টেক্সটাইল মিল স্কুলের এই বখাটে ছাত্র হত্যাকাণ্ডের পরই পালিয়ে যায় বলে পুলিশ দাবি করেছে। পরীক্ষার অসদুপায় অবলম্বন রুখতে গিয়ে প্রাণ দেয়ার এই মর্মান্তিক ঘটনায় স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি খবর পেয়েই সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই শিক্ষকের লাশ দেখতে যান।
নয়া দিগন্তসহ পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ, গত রোববার এসএসসির গণিত পরীক্ষা ছিল। চুনকুটিয়া গার্লস স্কুলে সিট পড়েছে ওরিয়েন্ট মিল স্কুলের পরীক্ষার্থীদের। ৩১০ নম্বর কক্ষে পরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন শিক্ষক গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া। সেদিন প্রথম থেকেই পরীক্ষার্থী রিয়াদ নকলের চেষ্টা করছিল। এমনকি সেজন্য সুযোগও দাবি করেছিল। মোস্তফা ভূঁইয়ার বারবার নিষেধ সত্ত্বেও তার নকল করা বন্ধ না হলে তিনি প্রধান শিক্ষক ইলিয়াস হোসেনকে জানান। পরীক্ষার শুরু থেকেই রিয়াদ শিক্ষকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করছিল। শিক্ষক মোস্তফা ভূঁইয়া বাধা দিলে তার ওপর বখাটে ছাত্রটি চড়াও হয়। পরে শিক্ষকেরা ঘটনার মীমাংসা করে দেন। তবুও রিয়াদ ওই শিক্ষককে হত্যার হুমকি দিয়ে যায়। নকল করতে না পেরে সে দেড় ঘণ্টা পরই বেরিয়ে গিয়েছিল। বিকেলে গিয়ে শিক্ষক মোস্তফাকে তার বাসায় খুঁজে আসে। পরদিন সকাল ৮টায় রিয়াদ তার বাসায় আবার ঢুকে পড়ে। তখন ওই শিক্ষক মেয়েদের প্রাইভেট পড়াচ্ছিলেন। তিনি রিয়াদের কাছে যাওয়ামাত্রই সে ধারালো চাকু দিয়ে তার বুকে আঘাত হেনে পালিয়ে যায়। হাসপাতালে নিলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ দিকে খুনের পরপরই রিয়াদের পরিবার বাসায় তালা দিয়ে আত্মগোপন করে। সে বাসার সামনে পুলিশ পাহারায়, এলাকাবাসী ুব্ধ। শিক্ষক গোলাম মোস্তফা স্ত্রী, দুই শিশুসন্তান রেখে গেছেন। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায়। শিক্ষামন্ত্রী হাসপাতালে লাশ দেখতে গিয়ে নিহত শিক্ষকের মাসহ আত্মীয় পরিজনকে আশ্বাস দিয়েছেন ঘাতকের যথোপযুক্ত শাস্তির। শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট এই হত্যার প্রতিবাদে রাজধানীতে ‘মানববন্ধন’ করেছে। এ দিকে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ শত শত মানুষ খুনির গ্রেফতার ও বিচার দাবিতে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক অবরোধ করেছিল।
পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন অর্থাৎ নকল করার অন্যায় প্রবণতা অনেক পুরনো। তবে নকল করতে বাধা পেয়ে শিক্ষককে হত্যার ঘটনা বিরল। আমাদের সমাজে চরিত্র ও মূল্যবোধের অবক্ষয় কত চরমে পৌঁছেছে এবং নৈতিকতায় কত বিরাট ধস নেমেছে, এর একটি নগ্ন প্রমাণ কেরানীগঞ্জে স্কুলশিক্ষক হত্যার এ ঘটনা। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রীর সবিশেষ প্রচেষ্টায় পাবলিক পরীক্ষায় নকলবাজি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরের সরকারগুলো এ ব্যাপারে কঠোরতা অব্যাহত রেখেছে। তবে কিছু অসৎ পরীক্ষার্থীকে নকলে লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এ জন্য শুধু পরীক্ষার্থী নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষককেও বহিষ্কার করছে। নকলবাজদের মধ্যে অবশ্য উল্লিখিত রিয়াদের মতো এ ধরনের কিশোর খুব কমই। এসএসসি পরীক্ষার্থী একটি ছেলে হয়তো হঠাৎ এমন বেপরোয়া হত্যাকারী হয়ে যায়নি। তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পটভূমির খোঁজ নিলে হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলবে।
আমরা আশা করি, শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিক্ষক গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়ার পরিবারকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দেয়ার পাশাপাশি তার প্রাপ্য অর্থ অবিলম্বে পরিশোধ এবং দুই শিশুসন্তানের পড়ালেখার সুব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সর্বোপরি পরিবারপর্যায়ে নৈতিক মূল্যবোধে সন্তানদের উজ্জীবিত করার দায়িত্ব পালন করতে হবে মা-বাবা, অভিভাবককে। শিক্ষক মোস্তফা ভূঁইয়া সততা ও দায়িত্বশীলতার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন জীবনের বিনিময়ে।