ব্যবসা ও অর্থনীতিডেস্ক(১৬ ফেব্রুয়ারী): সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটছে। একসময়কার কাঠ বা গ্রিল বাদ দিয়ে মানুষ এখন ঘরবাড়ি কিংবা সুউচ্চ দালানে অ্যালুমিনিয়াম ও কাচের দরজা-জানালা ব্যবহার হচ্ছে। দিন দিন এসব পণ্যের চাহিদাও বাড়ছে। আর এর প্রায় সবটুকুই দেশের শিল্পগুলোই জোগান দিচ্ছে।
অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র দেশে উৎপাদন হচ্ছে স্বাধীনতার আগ থেকেই। তবে স্বাধীনতার পরপরই ধীরে ধীরে তৈজসপত্র তৈরি ও বাজার সম্প্রসারণে নেতৃত্ব করতে থাকে অ্যালুমিনিয়ামের উৎপাদিত পণ্য। কিন্তু সাম্প্রতিককালে প্লাস্টিক ও স্টেইনলেস স্টিলের পণ্যসামগ্রীর কারণে প্রতিযোগিতায় পড়েছে এই শিল্প।উদ্যোক্তাদের মতে, অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র শিল্পটি এখন রুগ্ণ হয়ে যাচ্ছে।
এ দুই উপখাতের চিত্র বিপরীতমুখী। অ্যালুমিনিয়াম খাতে নতুন পণ্য তৈরির দিকে এগোচ্ছে। আর পুরাতন তৈজসপত্রের বাজার ছোট হয়ে আসছে। তারপরও সামগ্রিকভাবে অ্যালুমিনিয়াম শিল্পোদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকাও রাখছেন। এ ক্ষেত্রে উন্নতমানের পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে তাঁদের ঈর্ষণীয় সাফলতাও রয়েছে। সরকারের সুনজর পেলে দেশের চাহিদা পূরণ করে এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব—এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা।
অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি দরজা-জানালার কাঠামো, পার্টিশন, বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্রের কাঠামো জাতীয় পণ্যকে বলা হয় ‘অ্যালুমিনিয়াম প্রোফাইল’। জানা যায়, দেশের অভ্যন্তরে এ জাতীয় পণ্যের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩০ হাজার টন। টাকার অঙ্কে যা প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো। আর এর প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগই জোগান দিচ্ছে দেশীয় শিল্পগুলো।
বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়াম, কাই অ্যালুমিনিয়াম, পিএইচপি গ্রুপ, নিক্কি থাই, বিক্রমপুর ও ঢাকা থাইসহ ৮-১০টি প্রতিষ্ঠান এই অ্যালুমিনিয়াম প্রোফাইল তৈরি করে। এসব পণ্যের মূল কাঁচামাল হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম ইনগট। এই কাঁচামাল আসে জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও চীন থেকে।এ ছাড়া পণ্যে রং করতে ১২ থেকে ১৪ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বিদেশ থেকে আনতে হয়।
দেড় বছর আগে অ্যালুমিনিয়াম প্রোফাইল তৈরি শুরু করে পিএইচপি গ্রুপ।বর্তমানে দৈনিক ১২ টন পণ্য উৎপাদন করে পিএইচপি। শিল্পে ২৫০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে উন্নতমানের কাচ প্রস্তুত করে আসছে পিএইচপি। এই কাচের পণ্যের পরিপূরক হিসেবেই অ্যালুমিনিয়াম পণ্য উৎপাদনে আসে প্রতিষ্ঠানটি। তারা শিগগিরই ভারতের কলকাতায় অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানিও করবে। এ জন্য সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানালেন এক কর্মকর্তা।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আমির হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জনসংখ্যার সঙ্গে বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এ জন্য আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ দরকার। তাই অ্যালুমিনিয়াম প্রোফাইলের চাহিদা দিন দিনই বাড়ছে। দেশের শিল্পগুলো বেশ ভালোভাবেই তা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গ্যাস ও বিদ্যুৎসংকটের কারণে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। টাকা নিয়ে বসে থাকলেও আমরা গ্যাস সংযোগ পাচ্ছি না।’ অবকাঠামোগত এই সমস্যা সমাধানে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
অ্যালুমিনিয়াম প্রোফাইলের চাহিদা দিন দিন বাড়লেও উল্টো ঘটনা ঘটছে তৈজসপত্র উৎপাদন শিল্পে। প্লাস্টিকের আকর্ষণীয় পণ্যের জনপ্রিয়তায় অ্যালুমিনিয়ামের জগ, গ্লাস, মগ, বালতি ইত্যাদির উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তবে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, কড়াই, কলসসহ বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্রের এখনো ব্যাপক চাহিদা আছে। এসবের মূল ক্রেতা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ।
বাংলাদেশ অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক সমিতির দেওয়া তথ্যমতে, সারা দেশে অন্তত ৩০০টি তৈজসপত্র উৎপাদনকারী কারখানা আছে।এসব কারখানা রাজধানীর শ্যামপুর ও কামরাঙ্গীরচর, নারায়ণগঞ্জের পাগলা ও পঞ্চবটি ছাড়াও সাভার, ধামরাইতে গড়ে উঠেছে। আর এসব তৈজসপত্রের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার হচ্ছে রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বিহার ও মধ্যপ্রদেশ থেকে এসে কয়েকজন লোক বাংলাদেশে প্রথম অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল তৈরি শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর এসব কারখানা চলে আসে বাঙালিদের হাতে। নতুন অনেক উদ্যোক্তাও যুক্ত হন এর সঙ্গে।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ টি মোস্তফা হিন্দাল বলেন, নানা কারণে অ্যালুমিনিয়াম তৈজসপত্র শিল্পটি রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। সরকারের এ ব্যাপারে কোনো চিন্তা-ভাবনাও নেই। কিন্তু সম্ভাবনাময় পরিবেশবান্ধব এই খাতটিও দেশের অর্থনীতিতে ভালো ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, ‘কাঁচামাল আমদানিতে আমাদের ৩২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয়। তার ওপর বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। এ কারণে পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে।’ তিনি এ শিল্পগুলো বাঁচাতে কাঁচামাল আমদানির ওপর শুল্ক কমানো প্রয়োজন বলে মত দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উদ্যোক্তা বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক তৈজসপত্র তাঁরা তৈরি করতে পারছেন না। সে জন্য বিদেশের বাহারি পণ্য দেশে ঢুকছে। আকর্ষণীয় হওয়ায় দেশের ভোক্তারা তা কিনছেন। আর কোণঠাসা হয়ে পড়ছে দেশীয় পণ্য। এ জন্য তিনি প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক পণ্যসামগ্রী তৈরিতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
নিউজরুম্