নান্টু মিয়ার ভ্যালেন্টাইনস ডে

0
202
Print Friendly, PDF & Email

বুধবার বেলা সাড়ে ১০টায়ই স্কুলের দেয়াল টপকে বের হয়ে আসে নান্টু মিয়া। অবশ্য টিফিনের পর আরো দুটি ক্লাস ছিল। গত অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় সমাজবিজ্ঞানে ৩৩ মার্কস পেয়ে পাশ করার পর করার পর বাবা-মা-কে দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা এখন আর তার মাথায় নেই। দৌড়ে চলে যায় তেজঁগাও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের ওভার ব্রিজে।
 
বেলা ১২টায় ছুটির ঘণ্টা বাজে বালিকা বিদ্যালয়ে। ফার্মগেট ওভার ব্রিজের ওপর থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্র নান্টুর সন্ধানী চোখ ঠিকই খুঁজে নেয় মেয়েটিকে, সঙ্গে থাকা মাকে দজ্জালের মতো মনে হয় নান্টুর। গত ৫ দিন ধরেই শুভ্র ইউনিফর্মের মেয়েটিকে অনুসরণ করছে সে। চকিত চাহনির ক্ষণিক চোখাচোখির মধ্যেই এই টিনেজ নায়ক সদ্য দেখা ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ সিনেমাতে শাহরুখ খানের দেয়া হাসিটাও দিয়ে ফেলে মেয়েটিকে।
 
বাসায় ফিরলেও পড়া আর খাবারে মন বসে না নান্টুর। ভাবতে থাকে কীভাবে পরিচয় হওয়া যায় মেয়েটির সঙ্গে? সহপাঠী বন্ধু রানাকে কি সে তার প্রেমে পড়ার কথা বলবে? আবার যদি মেয়েটি প্রত্যাখ্যান করে, পরে বিয়ে করতে রাজি না হয়, রানা যদি এক কান দুই কান করে সবাইকে বলে দেয়, কি করে মুখ দেখাবে নান্টু মিয়া!

দুদিন আগে এম. জামান. লাইব্রেরি থেকে শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি কিনেছে সে। রাতে পড়ার টেবিলে পৃষ্ঠা ওল্টানো পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের নিচে একটু পরপর উকিঁ মারে অস্থির চোখ। আবার সতর্ক দৃষ্টি এই বুঝি মা এসে হাতেনাতে ধরে ফেলে। হুম… এই দেবদাসের মতোই সে ভালবেসেছে বালিকা বিদ্যালয়ের ওই মেয়েটিকে। নান্টুর চোখে ভেসে ওঠে ফুটপাথ দিয়ে চঞ্চল পায়ে হেঁটে যাওয়া সেই কিশোরীর কোমল ঠোঁটের হাসি, সেখানে সকালের বকুল ঝরে বাতাসে, দুপুরের রোদ হাসে মিষ্টি করে আর তারা জ্বলে ঝিকিমিকি রাতের ‍আকাশে।
 
সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে আলমারির আয়নার সামনে দাঁড়ায় নান্টু মিয়া। নাহ!  এবার মনে হয় গালের দুপাশের উঠতি দাড়িগুলো কামানো উচিৎ, ঠোঁটের ওপরে বেখাপ্পা লাগছে পশমের মতো গোফঁগুলোকে। এ কর্ম সম্পাদন ছাড়া নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। কিন্তু বড়রা অকালপক্ক বলতে পারে, লজ্জার কথা ভেবে আর সাহস পায় না ১৪ বছরের নান্টু। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বের হয়ে যায় সে, সকালে স্কুলে প্রবেশের আগে আরো একবার দেখতে হবে মেয়েটিকে।
 
টিভি নাটকের প্রেমের দৃশ্যগুলো ভালো লাগতে শুরু করেছে টিন-এজারের। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘মুহাব্বাতেঁ’, ‘কাহোঁ না পেয়্যার হ্যায়’ মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে নান্টু মিয়ার। ছবিগুলোতে নায়কদের প্রেম নিবেদন আর নাটকীয়তার ফ্রেমে নিজেকেও বসায় সে। বাসার টেকরেকর্ডারে বাজে অঞ্জন দত্তের গান, ‘স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়েটা..ছেলেটা দৌড়ে দৌড়ে এসে হাঁপায়…।’ নিজেকে গানেও খুজে পায় নান্টু।
 
পূর্বের রেকর্ডকে ভেঙে দিয়ে বার্ষিক পরীক্ষায় এক বিষয়ে ফেল করে ‘ফেলু’র তকমা নিয়ে বিশেষ বিবেচনায় দশম শ্রেণীতে পা রাখে নান্টু মিয়া।
 
ইংরেজিতে সাফল্য অর্জনের জন্যে বিশেষ চর্চার প্রয়োজনের ব্যাপারটি চাকুরে বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হয় সে। চোখে কাজল দেয়া কিশোরী স্কুল শেষে কোচিং করতে যায় ইংরেজি শিক্ষক আলম স্যারের বাসায়। সেখানেই প্রতিমাসে বাবার পকেটের ৫০০ টাকা খরচ করে স্বপ্নের প্রেমের ইনিংস শুরু করার স্বিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে।
 
তাজমহলের পথে অনেকটুকুই এগিয়ে গিয়েছিল নান্টু মিয়া। নবম শ্রেণী পড়ুয়া এ কিশোরীর নাম মিতু। শুধু স্কুল নয়, কোচিংয়ের আগে-পরেও মিতুকে অনুসরণ করার গুরুত্বপূর্ণ চাকরিতে মনোনিবেশ করে সে।
 
১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে আলম স্যার ভাঁজ করা যে কাগজটি হাতে ধরিয়ে দেন, তার গন্ধও পরিচিত নান্টুর কাছে। গত চার মাস ধরে কিশোরীকে নিয়ে সকল ভাবনা, সকল আবেদনের কথা লেখা আছে এই চিঠিতে। কাগজের ওপরে নানান রঙের কলমের কালিতে ব্যক্ত করেছিল ‘তোমাকে না পাওয়ার চেয়ে মৃত্যুও ভালো’ সেই আবেগের কথা।

ছিল প্রেমিকাকে নিয়ে লেখা তার আট লাইনের একটি কবিতা। ১০ জন সহপাঠীর সামনে দিয়ে সেদিন লজ্জায় মাথা নুইয়ে বের হয়ে যায় স্যারের বাসা থেকে। ব্যাচ থেকে বাদ পড়ে নান্টু।
 
১৪ ফেব্রুয়ারির পর আর আলম স্যারের বাসায় যাওয়া হয়নি। এক ভোরে বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মিতুকে দেখলেও, সঙ্গে থাকা দারোগারূপী মায়ের অগ্নিচক্ষু উপেক্ষা করে দ্বিতীয়বার ওই পথ মাড়ানোর সাহস জাগে না নান্টুর।
 
আর কিছুদিন পরেই দশম শ্রেণীর প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষা। ব্যস্ত হয়ে যায় নান্টু মিয়া। এ ব্যর্থ কিশোর প্রেমিকের ‘দেবদাস’ বিক্রি হয়ে গিয়েছে কাগজওয়ালার কাছে।
 
২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন ২৭ বছরের তরুণ নান্টু মিয়া। কাদের মোল্লাসহ একাত্তরের সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে টানা ১০ দিন ধরে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সে।
 
শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোতে গোলাপ আর রজনীগন্ধা কিনছে অনেকেই। নান্টুর চোখে ভেসে ওঠে সন্ধ্যার চিত্র—আজ সারাদেশে সন্ধ্যা ৭টায় একটি করে মোমবাতি জ্বালাবে সবাই। ভ্যালেন্টাইনের ভালোবাসায় আজ প্রতিবাদ জানানো হবে অন্যায়-অবিচার আর স্বৈরশাসনকে।
 
তারুণ্যের মনের ভেতর পাপমোচনের যে আগুন জ্বলছে তার লালচে শিখা থেকেই দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার দুরন্ত স্বপ্নের আঁচ পেতে চায় নান্টু। কৈশোরের প্রথম প্রেমের সেই কিশোরীর চেয়েও এ দেশটাকে অনেক বেশি ভালবাসে নান্টু মিয়া।
 
রোদ বাড়তে থাকে, ১৫ বছর বয়সী স্কুল ইউনিফর্ম পড়া নান্টু মিয়া আর মিতুরা দলে দলে ভীড় করে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে। স্লোগান তোলে, ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই…।’

আপলোড ১৪ফেব্রুয়ারী ২০১৩
 

শেয়ার করুন