কৃষি ডেস্ক(১১ ফেব্রুয়ারী): আলু ও টমেটো বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় দু’টি সবজি। সেই সাথে অর্থকরী ফসলও বটে। এ ফসল দু’টি চাষে স্বল্প সময়ে লাভ বেশি হওয়ায় শুধু কৃষকেরাই নয়, যারা কৃষিকাজের সাথে জড়িত নন এমন অনেকেই আলু চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন । কিন্তু কিছু বিষয়ের প্রতি ল না রাখায় অনেক সময় অনেকেই কাক্সিত ফল বা ফলন পান না। তখন বিভিন্ন জনকে বিভিন্নভাবে দোষারোপ করেন। তাই চাষে নামার আগে থেকেই যদি কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় তাহলে কাক্সিত ফলন নিশ্চিত করা সম্ভব। আলু ও টমেটো চাষে রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আলু ও টমেটো ফসল জমিতে থাকা অবস্থায় যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, তার মধ্যে নাভিধসা ও আগাম ধসা প্রধানতম দু’টি রোগ। নিচে রোগ দু’টি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
নাবী ধসা রোগ : সাধারণত যখন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ফসলের মাঠ। সারা দিন সূর্যের দেখা মেলে না। রাতের তাপমাত্রা কমে যায় স্বাভাবিকের চেয়েও অনেক কম। দিনে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। একে বলা হয় সঙ্কটাপন্ন আবহাওয়া। এই আবহাওয়ায় মাঠের ফসল, বিশেষ করে আলু ও টমেটোগাছে দেখা দেয় মড়ক। রোগটি আসলে লেট ব্লাইট বা নাবী ধসা। দিনে-রাতে কুয়াশা থাকায় তাপমাত্রা কমার পাশাপাশি আর্দ্রতাও বেড়ে যাওয়ায় এই রোগের জীবাণু দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সপ্তাহ খানেক পর দিনে কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর রোদ দেখা দিলেও রাতে আবার কুয়াশা পড়ায় মড়ক রোগের জীবাণু বৃদ্ধিতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
রোগের কারণ ও লণ : Phytophthora infestans নামে একধরনের ছত্রাকের কারণে রোগটি হয়। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় পাতা, পাতার বোঁটা, ডগা ও কাণ্ডে ছোট ছোট পানিভেজা আঁকাবাঁকা দাগ পড়ে। ধীরে ধীরে এই দাগ প্রথমে বাদামি ও পরে কালো রঙ ধারণ করে। এরপর দাগ আরো বড় হয়ে সব পাতা, ডগা ও কাণ্ডের চার দিকের বেশ কিছু অংশ ঘিরে ফেলে। আক্রান্ত দাগের চার দিকে ফ্যাকাশে সবুজ ও বাদামি রঙের বলয় দেখা যায়। দাগগুলো পাতার কিনারার দিক থেকে ভেতরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাতার নিচে সাদা সাদা গুঁড়ার মতো জীবাণু দেখা দেয়। এই জীবাণু সামান্য বাতাসেই উড়ে গিয়ে অন্য সুস্থ গাছের পাতা ও ডগা সংক্রমণ করে।
বাতাসের আপেকি আর্দ্রতা বেশি (৯০-১০০%) থাকলে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই েেতর বেশির ভাগ গাছ আক্রান্ত হয়ে পড়ে।মারাত্মকভাবে আক্রান্ত েেত একধরনের বিশেষ গন্ধ বা পোড়া গন্ধ পাওয়া যায়।তে দেখে মনে হয় সব আলুগাছ পুড়ে গেছে। মাটির নিচের আলুতে পচন ধরে। টমেটোর ফল আক্রান্ত হলে বোঁটার কাছাকাছি জায়গা থেকে কালো দাগ পড়ে এবং পচন শুরু হয়।
উপযোগী পরিবেশ : রাতের তাপমাত্রা ১২ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দিনের তাপমাত্রা ২০ থেকে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আপেকি আর্দ্রতা ৯০-১০০% হলে ছত্রাক খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ঘন কুয়াশা ও মেঘলা আবহাওয়ায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। সঙ্কটাপন্ন আবহাওয়া, বিশেষ করে দিনের বেলা মেঘলা আকাশ ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হলে রোগ দ্রুত মাঠে ছড়িয়ে পড়ে।
বিস্তার : আক্রান্ত টমেটো বা আলুবীজের মাধ্যমে এই ছত্রাক পরের বছরে রোগ ছড়ায়।অনেক সময় আক্রান্ত টমেটো বা আলুগাছ থেকেও এই রোগ সুস্থ টমেটো বা আলুগাছে ছড়ায়। এই রোগের বীজাণু বা স্পোর বাতাস ও পানির ছিটার মাধ্যমে েেতর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত তে থেকে কোনো অবস্থায় বীজ নেয়া উচিত নয়। প্রত্যয়িত বীজ ব্যবহার করতে হবে। তে সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হয়। ফসল তোলার সময় আক্রান্ত গাছ ও পাতা যেন টিউবার বা কন্দের সাথে না লাগে সে দিকে ল রাখতে হয়। রোগাক্রান্ত সম্পূর্ণ আলুগাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে বা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়। রোগাক্রান্ত আলুবীজও মাটিতে পুঁতে ফেলা উচিত। আক্রান্ত েেতর আলুগাছ সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার পর আলু তুললে পাতার ছত্রাক মরে যায়, ফলে টিউবার বা কন্দ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। গাছের গোড়ার মাটি উঁচু করে দিলে মাটির নিচের আলুকে রোগ-বীজাণু থেকে রা করা যায়। বৃৃৃষ্টির পর বা ভেজা মাটিতে কখনো আলু তোলা উচিত নয়, এতে পাতা ও মাটি থেকে আলু সংক্রমিত হতে পারে। আলু তুলে ফেলার পর পরিত্যক্ত অংশগুলো একত্র করে পুড়িয়ে ফেলতে হয়।
আগাম জাতের আলু চাষ করলে অনেকাংশে এই রোগ এড়ানো যায়। আক্রান্ত েেত যথাসম্ভব সেচ প্রদান বন্ধ রাখতে হয়। আলুবীজ শোধন করে লাগাতে হবে। আলুবীজ শোধনের জন্য ফরমালিন ১ : ৪০০ অনুপাত দ্রবণে আলুবীজ তিন-পাঁচ মিনিট ডুবিয়ে রেখে এরপর ভেজা গানি ব্যাগে দুই ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এতে আলুর মধ্যস্থিত জীবাণু মারা যায়।
রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতি লিটার পানিতে শুধু ম্যানকোজেব ২ দশমিক ৫ গ্রাম ১০-১২ দিন পর পর ¯েপ্র করতে হবে।পরবর্তী সময়ে কুয়াশা ও মেঘলা আবহাওয়া বিরাজ করলে প্রতি লিটার পানিতে ম্যানকোজেব + মেটালেক্সিল (রিডামেল গোল্ড, করমিল, মেটারিল, নিউবেন ইত্যাদি) দুই গ্রাম বা সিকিউর দুই গ্রাম মিশিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। ওপরে উল্লিখিত ছত্রাকনাশক কাজ না করলে প্রতি লিটার পানিতে সিকিউর এক গ্রাম+মেলেডি ডুও দুই গ্রাম মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর দুই-তিনবার ¯েপ্র করতে হবে। ছত্রাকনাশক ¯েপ্র করার সময় গাছের পাতার নিচে, ওপরে ও কাণ্ডসহ ¯েপ্র করতে হবে।পাওয়ার ¯েপ্রয়ার ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়।
অনেক সময় টমেটো বা আলুতে আক্রান্ত হওয়ার পর মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে কোনো ফল পাওয়া যায় না। এ েেত্র অ্যাক্রোবেট অথবা মেলোডি ডিউ অথবা রিডোমিল গোল্ড আলুেেত স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার সময় পাতার উভয় দিকসহ সম্পূর্ণ গাছ ভিজিয়ে দিতে হয়। এই ছত্রাকনাশকগুলোর যেকোনো একটি সাত দিন পরপর দুই থেকে তিনবার ¯েপ্র করতে হবে। যদি কুয়াশা দীর্ঘায়িত হয় তাহলে যত দিন কুয়াশা থাকে তত দিন সপ্তাহে দুইবার স্প্রে করা ভালো। সঙ্কটাপন্ন আবহাওয়ায় যারা মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক তিন থেকে চার দিন পর পর ব্যবহার করবেন তাদের তে কম তিগ্রস্ত হবে। কিন্তু এই সময়ে ছত্রাকনাশক ব্যবহার না করলে গাছ আক্রান্ত হওয়ার পর ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে অনেক সময় ভালো ফল পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এ রোগের জন্য প্রতিকার অপো প্রতিরোধ উত্তম।
আগাম ধসা রোগ : অতীতে সাধারণত মওসুমের শুরুতে এ রোগ দেখা গেলেও এখন যেকোনো সময়ই আলু ও টমেটোতে এ রোগ দেখা দিতে পারে। বাংলায় আগাম ধসা বলা হলেও ইংরেজিতে আর্লি ব্লাইট নামে ডাকা হয়।
রোগের কারণ ও লণ : Alternaria solani নামে একধরনের ছত্রাকের কারণে রোগটি হয়। নিচের পাতায় ছোট ছোট বাদামি রঙের অল্প বসে যাওয়া কৌণিক দাগ পড়ে। আক্রান্ত অংশে সামান্য বাদামি এলাকার সাথে পর্যায়ক্রমে কালচে রঙের চক্রাকার দাগ পড়ে। পাতার দাগে বৃত্তাকার পর্যায়ক্রমিক দাগই এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আক্রমণ ব্যাপক হলে পাতার আনেক দাগ একত্র হয়ে পাতার একটি বড় অংশকে পচিয়ে দেয়। পাতার বোঁটা ও কাণ্ডের দাগ অপেক্ষাকৃত লম্বা ধরনের হয়। গাছ হলদে হয়, পাতা ঝরে পড়ে।অকালে গাছ মরে যেতে পারে। আক্রান্ত টমেটো ফল ও আলুতে পচন দেখা যায়। এ রোগের আক্রমণে টমেটো ফলের বোঁটার নিচ থেকে পচন শুরু হয়।
উপযোগী পরিবেশ : এ ছত্রাকের জন্য সবচেয়ে উপযোগী তাপমাত্রা হলো ২৬-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃষ্টিপাত ও কুয়াশা রোগের আক্রমণকে ত্বরান্বিত করে। অধিক ফলনশীল গাছে এ রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যায়। জমির উর্বরতা কম হলে রোগের প্রকোপ বেশি হবে।
বিস্তার : আক্রান্ত টমেটো বা আলুবীজের মাধ্যমে এই ছত্রাক পরের বছরে রোগ ছড়ায়। অনেক সময় আক্রান্ত টমেটো বা আলুগাছ থেকেও এই রোগ সুস্থ টমেটো বা আলুগাছে ছড়ায়। এই রোগের বীজাণু বাতাস ও পানির ছিটার মাধ্যমে েেতর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। জমিতে থেকে যাওয়া আলুতে এবং ফসলের অবশিষ্টাংশে এ রোগের জীবাণু বেঁচে থাকে।
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত তে থেকে কোনো অবস্থায় বীজ নেয়া উচিত নয়।প্রত্যয়িত বীজ ব্যবহার করতে হবে। তে সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হয়।প্রতিরোধ মতাসমপন্ন জাতের চাষ করতে হবে। সুষম সার প্রয়োগ এবং সময়মতো ও পরিমিত সেচ প্রয়োগ করতে হবে। বীজের ওজনের ০ দশমিক ২৫% হারে ভিটাভেক্স ২০০-এর দ্রবণে বীজ শোধন করে নিতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ইপরিডিওন গ্র“পের ছত্রাকনাশক যেমন রোভরাল দুই-তিন গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন অন্তর অন্তর ¯েপ্র করতে হবে। এ ছাড়াও ডায়থেন-এম ৪৫, নেমিসপোর প্রভৃতি প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ¯েপ্র করলে সুফল পাওয়া যাবে।
আলু ও টমেটো চাষে এ দু’টি রোগ প্রতি বছরই কৃষকদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই রোগ দু’টির েেত্র বিস্তারিত জানা থাকলে দমন করতে সুবিধা হয়। অনুকূল আবহাওয়া দেখা দেয়ার সাথে সাথে ছত্রাকনাশক ¯েপ্র করে রোগকে মোকাবেলা করা যায়। অথবা আক্রমণের শুরুতেই ব্যবস্থা নিলে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু রোগ সংক্রমিত হওয়ার পর দমন করা কঠিন। এ জন্য কৃষক ভাইদের সব সময় তাদের জমি পর্যবেণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক
উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
নিউজরুম