কৃষি ডেস্ক(১১ ফেব্রুয়ারী): ফলে ভরা ফুলে ভরা এমন দেশ আর নেই। একটা সময় যখন ছিল যখন গোলা ভরা ধান আর গলা ভরা ছিল গান। সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা এই সবুজ বাংলা থেকে ক্রমেই ফল ও ফুলের সাথে প্রকৃতিবান্ধব প্রায় ২৫-৩০ প্রজাতির দেশীয় ধান বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মানবদেহের জন্য উপকারী বিভিন্ন জাতের ধান। অথচ একটা সময় ছিল চিরন্তন বাংলার দিগন্তজোড়া মাঠে মাঠে নানা স্বাদ ও গন্ধের এসব দেশীয় জাতের ধান বেশি চাষ হতো ।
স্বকীয় গুণাবলিবিশিষ্ট দেশীয় জাতের ধান উৎপাদনে গ্রামবাংলার কৃষকের ছিল অদম্য আগ্রহ। উৎপাদন খরচ কম, মানবদেহের জন্য উপকারী এবং সুুস্বাদু পিঠা-পায়েস, খই-মুড়ি ও চিঁড়া-মুড়ি তৈরিতে এসবের জুড়ি মেলান ছিল খুবই সহজ ।
গবেষণালব্ধ উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষ বেশি লাভজনক হওয়ায় কৃষকেরা সে দিকে ঝুঁকে পড়ায় ক্রমেই অপরূপা বাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিবান্ধব প্রায় ২৫-৩০ প্রজাতির দেশীয় ধান। এর মধ্যে গৌরীকাজল, লক্ষ্মীণতা, নোড়াই সাটো, পরাঙ্গি দীঘা, হাসবুয়ালে, ভোরানটা, মানিকদীঘা, খৈয়ামটর, দলকচু, পঙ্খিরাজ, বাঁশিরাজ, ঝিঙেঝাল, দেবমণি, দুধমণি, কালাবায়রা, ধলাবায়রা, গন্ধকোস্তের, আশ্বিন দীঘা, আশ্বিন মালভোগ, দুধকলম উল্লেখযোগ্য।
জমি নির্বাচন : দেশীয় এসব জাতের ধানচাষে সমতল ভূমির প্রয়োজন হয় না। উঁচু-নিচু ঢালু জমিতে এর চাষ হয়। নিচু এবং বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়া অথবা বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় যেসব জমিতে অন্য ফসল অবাদ করা সম্ভব নয় , সেসব জমিতে এর চাষ করা হয়।
চাষ সুবিধা : যেসব জমিতে স্থায়ীভাবে পাঁচ-ছয় ফুট পানি জমে থাকে, যেখানে উফশী (রোপা আমন) জাতের ধান ডুবে নষ্ট হয়ে যায়; এমন জমিতে দেশীয় জাতের ধান চাষ করার বিকল্প নেই। প্রকৃতিবান্ধব এসব দেশীয় জাতের ধান আবাদে রয়েছে বিভিন্ন সুবিধা। মওসুমের শুরুতে জমিকর্ষণ করে বীজ বপন করা হয়। সার, কীটনাশক ও সেচ দেয়ার দরকার হয় না। রোগ প্রতিরোধ মতা বেশি হওয়ায় পোকামাকর আক্রমণ কম। নিড়ানিও কম। চার-পাঁচ ফুট পানির ওপর ভেসে মাথা উঁচু করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় অনায়াসেই।
উপকারিতা : মানুষের দেহ-মনের জন্য এসব জাতের ধানের চালের ভাত যথেষ্ট উপকারী।সুস্বাদু পিঠা-পায়েশ, চিঁড়া-খই ও মুড়ি তৈরিতে দেশীয় এসব জাতের ধানের কোনো তুলনা হয় না। সার-কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না বিধায় আবাদি ভূমির উর্বর শক্তি হ্রাস পায় না ।
বিলুপ্তির কারণ : প্রাচীনতম দেশীয় জাতের এসব ধানচাষ অপোকৃত কম লাভজনক। ফলে গবেষণালব্ধ উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের ধানচাষ বেশি লাভজনক হওয়ার সে দিকে ঝুঁকে পড়ছেন কৃষকেরা। যে কারণে দেশ থেকে ক্রমেই বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিবান্ধব প্রায় ২৫-৩০ প্রজাতির ধান ।
উফশী ধান চাষের অসুবিধা : দেশীয় জাতের ধান অবাদ থেকে উফশী ধানচাষে ফলন বেশি এবং লাভজনক। তবে দেশীয় ধানচাষে আবাদি ভূমির কোনো তি হয় না। কিন্তু গবেষণালব্ধ আধুনিক পদ্ধতির ধানচাষে অতিরিক্ত মাত্রায় সার-কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় । ফলে আবাদি ভূমি তিগ্রস্ত হয়ে উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে। স্থান ও অঞ্চলভেদে এসব দেশীয় জাতের ধানের রয়েছে বিভিন্ন নাম, গুণ ও বৈশিষ্ট্য।
দেশের সব অঞ্চলেই এক সময় প্রায় ২৫-৩০ জাতের দেশীয় এসব ধানের চাষ হতো। নবান্ন উৎসবের সাথে গ্রামের ঘরে ঘরে সুস্বাদু পিঠা-পায়েশ, খই-মুড়ি ও চিঁড়া-মুড়কি তৈরিতে উৎসবও চলত ধুমধামের সাথে।
গ্রামের অনেক এলাকায় প্রবীণ কৃষকেরা এখনো এসব প্রাচীন জাতের ধানচাষ ধরে রেখেছেন।কৃষি বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, সরকারিভাবে চাষিপর্যায়ে বীজ উৎপাদন, সংরণ, বিতরণ ও জাত নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে উচ্চ ফলনশীল জাতের পাশাপাশি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবেলায় নিজস্ব মতাসম্পন্ন বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় বিভিন্ন জাতের ধানের চাষ বাড়বে।
নিউজরুম