১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩।।
একটি সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের ভেতরে-বাইরে সব স্তরে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ করে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা। সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপ সত্ত্বেও কোথাও যদি কোনো ব্যক্তি বা মহল দুর্নীতি করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়। সরকার দুর্নীতিবাজদের ছেড়ে কথা বলা উচিত নয়, সে দুর্নীতিবাজ যেই হোক না কেন। কিন্তু মানুষ যখন দেখে, সরকারি আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে দেশে দুর্নীতির মহোৎসব চলে, তখন দুর্নীতির সাম্রাজ্য পত্রপল্লবে বিকশিত হয়। আইনের শাসন হয় নির্বাসিত। তখন দুর্নীতিবাজেরা নির্ভয়ে দুর্নীতিকর্মে লিপ্ত হয়।
আমাদের দেশের অবস্থা অনেকটা সে রকম। নইলে পদ্মা সেতু ও রেলওয়ের নিয়োগবাণিজ্য নামের দুর্নীতি এবং শেয়ারবাজার, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারির মতো দুর্নীতির নানা উপাখ্যানের কথা আমাদের শুনতে হতো না। শুনতে হতো না সরকারি ব্যাংক-বীমা খাতে শত শত কোটি টাকা লোপাটের কাহিনী।
নয়া দিগন্ত গতকালের শীর্ষ সংবাদে জানিয়েছে, নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে মাত্র এক বছরে বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক-বীমা থেকে লোপাট করা হয়েছে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ‘ফোর্সড লোন’ সৃষ্টি, যাচাই-বাছাই না করেই বিপুল ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলা, কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত ঋণ দেয়া, বন্ধ প্রতিষ্ঠানকে এবং পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া ঋণ দেয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে এই বিপুল অর্থ লোপাট করা হয়েছে। বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের সিজিএ কার্যালয়ের করা সর্বশেষ এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গত মাসে এই প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে।
সিজিএ প্রতিবেদন অনুযায়ী নিরীক্ষার বছর হিসেবে ধরা হয়েছে ২০০৯-১০ অর্থবছরকে। সরকারি মোট আটটি ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানে নিরীক্ষা চালানো হয়। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছেÑ সোনালী ব্যাংক (বিবি এভিনিউ করপোরেট শাখা, স্থানীয় কার্যালয়, প্রধান কার্যালয়, চট্টগ্রামের লালদীঘি ও আগ্রাবাদ করপোরেট শাখা)। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের জয়পুরহাট, নওগাঁ ও রংপুরের জোনাল অফিস, রূপালী ব্যাংকের বরিশাল সেন্ট্রাল বাস টার্মিনাল, জিন্নাগড়, চরফ্যাসন ও লালমোহন শাখা, অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, জনতা ব্যাংকের খুলনা খান এ সবুর রোড, চুয়াডাঙ্গা এরিয়া শাখা ও প্রধান কার্যালয় এবং বগুড়া এরিয়া শাখা, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পাবনা শাখা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান শাখা, সাধারণ বীমা করপোরেশন প্রধান কার্যালয় ও ঢাকা জোনাল অফিস এবং জীবন বীমা করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়। এই শাখাগুলোতে নিরীক্ষায় যে ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়েছে, অন্য অনেক শাখাতেও তেমনি অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় বলেই অনেকের বিশ্বাস।
অডিট প্রতিবেদন অনুসারে, সবচেয়ে বড় চুরি ও অনিয়ম করে অর্থ লোপাট করা হয়েছে ‘ফোর্সড লোন’ সৃষ্টির মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ফোর্সড লোন সৃষ্টির মাধ্যমে বিনামূল্যে পরিশোধ এবং অনিয়মিত বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার ফলে ক্ষতি হয়েছে ৮৫ কোটি ৫০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, যার পুরোটাই লোপাট করা হয়েছে।’ অন্যান্য অনিয়মের কথাও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
সরকারি ব্যাংক-বীমা খাতে এ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীটি বন্ধ করতে অবিলম্বে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে লোপাট হওয়া অর্থ উদ্ধার করা দরকার। অনিয়ম আর দুর্নীতির রশি টেনে ধরতে না পারলে ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে।