বিনোদন ডেস্ক(০৯ ফেব্রুয়ারী): দিন দিন হু হু করে আমাদের টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর এসব চ্যানেলের জন্য নির্মাতারা রাতদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একের পর এক ধারাবাহিক নির্মাণ করে যাচ্ছেন। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের টিভি দর্শকরা দেশীয় টিভি ধারাবাহিক দেখার চেয়ে ভারতীয় হিন্দি ও কলকাতার বাংলা সিরিয়ালের প্রতি বেশি আসক্ত। নির্মাতাদের কেউ কেউ তাদের কাজ দিয়ে দেশীয় টিভি দর্শকদের ভারতীয় সিরিয়াল থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তারা নিজেদের কাজের প্রতি দর্শকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলেও অধিকাংশ নির্মাতার কাজ মানহীন বা দর্শকদের আকৃষ্ট করার মতো না হওয়ায় তাদের সেই স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন ঘটছে না। আমাদের নাট্য-বোদ্ধাদের অনেকেই বলছেন, নাটক নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরেই এই কাজটি অত্যন্ত সহজ করে ফেলা হয়েছে। ধারাবাহিকগুলোতে একই চেহারার অভিনয় শিল্পী, একই লোকেশন, একই বিষয়বস্তু নিয়ে একের পর এক কাজ হওয়ায় তা দর্শক টানতে পারছে না বলে মনে করছেন মিডিয়া সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ। প্রায়ই দেখা যায়, কোনো বিষয় নিয়ে নির্মিত একটি ধারাবাহিক দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পরই সেই একই বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক নির্মাণের জোয়ার শুরু হয়। আবার কোনো অভিনয় শিল্পী বিশেষ কোনো চরিত্র বা বিশেষ কোনো অঞ্চলের ভাষায় কাজ করে সফল হলেই তাকে পরবর্তী নাটকগুলোতে একই চরিত্রে ডাকা শুরু হয়। এগুলোকেই নতুন ধারাবাহিকের দর্শকপ্রিয়তার প্রধান অন্তরায় বলে মনে করছেন অনেকে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, টিভি নির্মাতাদের মধ্যে একটা দল সিনিয়র নির্মাতার সঙ্গে দুই একটি নাটকে সহকারী হিসেবে কাজ করে অনায়াসে ১ ঘণ্টার নাটক নির্মাতা বনে যাচ্ছেন। আর এ কাজেও ভালো করে দক্ষতা অর্জন করা ছাড়াই অল্প সময়ের ব্যবধানে ধারাবাহিক নাটক নির্মাণের দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। এজাতীয় নির্মাতার কাজ আবার বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারও হচ্ছে। এ অবস্থায় তাদের নাটকে কোনো গল্প পাওয়া যায় না। নাটকে কোনো নাটকীয়তা নেই। দর্শক ধরে রাখার কোনো কৌশল দেখা যায় না এসব নির্মাতার কাজে। ফলে এভাবে কাজ হওয়ায় আমাদের টিভি দর্শকদের মাঝে এই ধারাবাহিক কোনো রকম আকর্ষণ জাগাতে পারছে না। আর তাই ভিনদেশি কাজের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা থেকেই তারা ভারতীয় চ্যানেলে পাড়ি জমায়। এভাবে দিন দিন চলার কারণে দেশীয় টিভি ধারাবাহিকগুলো দর্শকশূন্য হয়ে পড়েছে। যদিও আমাদের নির্মাতাদের অনেকে জোর গলায় বলে থাকেন, আমাদের নাটক টিআরপি’তে এক নম্বরে রয়েছে। এই একই কথা যখন একই সময়ে বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার চলতি ধারাবাহিকের নির্মাতারা বলে থাকেন—তখন সেই কথার যথার্থতা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। একশ্রেণীর নির্মাতার কারণে আমাদের ধারাবাহিকগুলো ক্রমেই আমাদের সংস্কৃতির মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতেও সত্যিকার অর্থেই যারা নাটককে ভালোবাসেন, নাটকই যাদের মন-প্রাণ—সেসব নির্মাতা মানসম্পন্ন যে ধারাবাহিক নির্মাণ করে থাকেন, তা দর্শকপ্রিয়তাও পেয়ে যাচ্ছে। তবে তাদের মধ্যে এক শ্রেণী ভালো কাজ জানার পরও অতিরিক্ত মুনাফালোভী হওয়ায় নিজের কাজ দিয়ে দর্শকপ্রিয়তার আলো জ্বালতে পারছেন না। আমাদের টিভি ধারাবাহিক কেন দর্শক টানতে পারছে না—এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে খ্যাতিমান নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুল বললেন, ‘আগে আমরা ধীরে সুস্থে কাজ করতাম। একটি ধারাবাহিকের শুটিংয়ের আগে সুন্দর একটা ডিজাইন করতাম কীভাবে কাজটি করব। এরপর অভিনয় শিল্পীদের নিয়ে বসতাম। রিহার্সেল হতো। শিল্পীরাও চেষ্টা করতেন ভালো কিছু করার। কিন্তু এখন সেটা হয় না। এখন একজন অভিনয় শিল্পীকে কাজের ১৫ দিন আগে স্ক্রিপ্ট পাঠালেও তিনি ঠিকমত স্ক্রিপ্ট পড়েন না। দেখা যায়, শুটিং স্পটে এসে স্ক্রিপ্টে চোখ বুলিয়েই অভিনয় শুরু করে। এতে করে তো তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। দেখা গেল, একজন আর্টিস্টকে আগে বলে দেয়া হলো, আপনাকে এই এই পোশাক আনতে হবে। কিন্তু শুটিংয়ে দেখা যায় সে কিছু আনেনি।এভাবে কাজ হলে তা দর্শকদের ভালো লাগবে কী করে। আর একজন নির্মাতা ভালো কাজ করতে চাইলেও সম্ভব হয় না অনেক সময়। কারণ, বাজেটের বেশিরভাগ টাকা তো অভিনয় শিল্পীদেরই দেয়া লাগে। নির্মাতার ভালো পারিশ্রমিকের বিষয়টি নিশ্চিত করা না গেলে ভালো কাজ তিনি করবেন কী করে। তবে অনেক সময় নির্মাতার নানা গাফিলতির কারণেও কাজটি মানহীন হয়। আমি আমাদের কিছু কিছু ধারাবাহিক দেখতে বসলেই বিরক্তি অনুভব করি। নাটকে গল্পের আগামাথা পাওয়া যায় না। সংলাপে গভীরতা নেই।হাসির কোনো বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়—যা খেলো মনে হয়। ভারতীয় সিরিয়ালে দেশীয় দর্শকদের আসক্তির কারণ উল্লেখ করে সাইদুল আনাম টুটুল আরও বলেন, ‘ভারতীয় সব সিরিয়াল যে ভালো তা নয়। কিছু কিছু সিরিয়ালে অনেক গাঁজাখুরি বিষয়বস্তুও দেখা যায়। ওরা অনেক নেতিবাচক বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করে, যা আমরা দেখাতে পারি না। আমাদের সমাজ, চ্যানেলগুলো তা গ্রহণ করবে না। আসলে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের স্বাভাবিকভাবেই বেশি আকর্ষণ থাকে। আমাদের নাটকে আমরা সেই বিষয়গুলো তুলে ধরা থেকে বিরত থাকি।’
নিউজরুম