৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩।।
মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলেন না বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭৪ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত শীর্র্ষ সম্মেলনে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম অংশগ্রহণের পর থেকে ওআইসির খুব কম শীর্ষ সম্মেলন ছিল, যেখানে বাংলাদেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান অংশ নেননি। এবারের সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করেছে। ওআইসির এই ১২তম শীর্ষ সম্মেলনে ২৬ জন শীর্ষ নেতা যোগ দেন। এতে ওআইসির বিদায়ী সভাপতি ও সেনেগালের প্রেসিডেন্ট ম্যাকি সাল মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির কাছে তার দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। এবারের সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কটগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই ফোরামে সদস্যদেশগুলোর রাজনৈতিক ইস্যুগুলো সাধারণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হলেও এবার ফিলিস্তিনের পাশাপাশি সিরিয়া ও মালি সঙ্কট নিয়েও কথা হয়েছে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর এই প্রথম মিসর সফর করছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ। সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা: দীপু মনি মুসলিম উম্মাহর প্রতি অধিকতর ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নিজস্ব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
ওআইসি ইসলামি দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ ও সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ করার ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান অতীতে রেখেছে। যদিও এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ওআইসিকে কেন্দ্র করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এক সময় যে স্বপ্নের সঞ্চারণ হয়েছিল তার পুরোটা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। বিশ্ববাস্তবতা এবং মুসলিম দেশগুলোর নেতৃত্বের অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কারণে এটিই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ইসলামি সম্মেলন সংস্থাকে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থায় রূপান্তর এবং উম্মাহর মধ্যে সহযোগিতার বাস্তবসম্মত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ এই সংস্থাকে নিয়ে নতুন করে আশাবাদী হওয়ার কারণ সৃষ্টি হয়েছে। সিরিয়া সঙ্কটের আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কার্যকর রূপ লাভের ব্যাপারে সাফল্য এলে সংস্থাটি মুসলিম উম্মাহর নতুন করে স্বপ্ন দেখার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে একসময় বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ছিল ওআইসিতে। ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৪ সালে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করে অনেক বৈরিতা ও বাধাকে জয় করে বঙ্গবন্ধু ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। মুসলিম দুনিয়ার গুরুত্ব এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরো অনেক বেশি হওয়ার পরও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কায়রো সম্মেলনে অংশ নেননি। সংবিধানে মুসলিম বিশ্বের সাথে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার অনুচ্ছেদ পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের অগ্রাধিকার নিরূপণেও এর প্রভাব হয়তো লক্ষ করা যাচ্ছে। এর আগে ইসলামাদে অনুষ্ঠিত ডিএইট শীর্ষ সম্মেলনে শেষ মূহূর্তে অংশ নেয়া থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিরত হওয়ার পর এবারের ওআইসি সম্মেলনে না যাওয়ায় মহাজোট সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অনেকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করতে পারেন।
আমরা মনে করি, পররাষ্ট্রনীতি সরকারে বিভিন্ন দলের আসা-যাওয়ার সাথে পরিবর্তন হওয়ার কোনো বিষয় নয়। এর সাথে রাষ্ট্রের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির যেমন সম্পৃক্ততা থাকে তেমনিভাবে অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক বৈদেশিক কর্মসংস্থান আন্তর্জাতিক ফোরামে অভিন্ন স্বার্থ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় আনতে হয় পররাষ্ট্র সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের কোনোভাবেই মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ককে গৌণ করে দেখার সুযোগ নেই। এটি উপলব্ধি করতে না পারলে এ জন্য আরো বড় মূল্য দিতে হতে পারে দেশকে।