রুপসীবাংলা ডেস্ক: চলতি বছর ‘বাংলাদেশ বিশেষভাবে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছে বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট। বিশ্বব্যাপী বহুল পঠিত এই সংবাদপত্রটি বলেছে, দাতা সংস্থাগুলো পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশের বৃহত্তম এ প্রকল্পের ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
গতকাল সংবাদপত্রটির অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫ কোটি ৩০ লাখ লোক এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। নিবন্ধে বাংলাদেশের বিদ্যুত্ খাতের করুণ চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক জরিপমতে বিদ্যুত্ সুবিধার দিক দিয়ে ১৮৫টি দেশের মধ্যে সবার নিচে বাংলাদেশ ১৮৫তম! রাশিয়া থেকে ঋণ নেয়া প্রসঙ্গে নিবন্ধে বলা হয়েছে, যদিও পুতিনের ঋণ দেয়ার শর্তগুলো অন্য দাতাদের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে খারাপ, তবে রাজনৈতিকভাবে তা যথেষ্ট ‘লোভনীয়’। ‘স্পেন্ডিং ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধটিতে প্রকাশ করা হল :
বিশ্বসেরা রেকর্ডের কমতি নেই বাংলাদেশের। সবচেয়ে জনবহুল দেশ দিয়েই শুরু করা যাক। রাজধানী ঢাকা বিশ্বের উদীয়মান শহর।
সবচেয়ে বেশি সময় ধরে নারী নেতৃত্বের অধীনে থাকা এ দেশেই শুরু হয় বিশ্বের বৃহত্তম ও সেরা বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ব্র্যাক। চমত্কার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও এখনও দেশের মোট জনসংখ্যার ঠিক এক-তৃতীয়াংশ অথবা ৫ কোটি ৩০ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশেই তৈরি হওয়ার কথা ছিল দাতাদের অর্থায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু। ৩০০ কোটি ডলার ব্যয়সাপেক্ষ সেতুটি তৈরি হলে এটিই হতো নদীর ওপর নির্মিত বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু। তবে বাংলাদেশ সরকার সেতুর অর্থদাতার তালিকা থেকে বিশ্বব্যাংককে বাদ দেয়ায় সেতুর ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে ১২০ কোটি ডলারের সহজ শর্তের ঋণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। সব ঠিকঠাক থাকলে এটি হতো বিশ্বব্যাংকের কোনো দেশকে এককালীন দেয়া সর্বোচ্চ ঋণ।
বিশ্বব্যাংককে বাতিল করার ঠিক আগের দিনই সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম জানিয়েছিলেন, বিশ্বব্যাংকের কাজে দুর্নীতি ধরা পড়লে তা সহ্য করা হবে না। সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে যথেষ্ট সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ সরকার।
এর পরপরই ঋণদানে অস্বীকৃতি জানায় বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এডিবি ও জাইকা। এর ফলে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের ঋণই বাতিল হয়ে যায়। ফলাফল—যমুনা ও পদ্মার কারণে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন ৩ কোটি মানুষকে আরও ধৈর্য ধরতে হবে।
কিছুক্ষণের জন্য সেতুর কথা ভুলে যাই। গত বছর প্রথমবারের মতো স্যাটেলাইট (কৃত্রিম উপগ্রহ) নিক্ষেপের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত সপ্তাহে দেশের প্রথম সাবমেরিন (ডুবোজাহাজ) কেনার পরিকল্পনার কথা বলেছে সরকার। আর সবশেষে বাংলাদেশের এ যাবত্কালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প শুরু হতে যাচ্ছে শিগগিরই—পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
৫০ বছর আগে পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালে এটি নির্মাণের কথা উঠেছিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিনের সাহায্যে এবার শুরু হতে যাচ্ছে এ প্রকল্প। যদিও পুতিনের ঋণ দেয়ার শর্তগুলো অর্থনৈতিকভাবে বেশ কঠিন; তারপরও রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট ‘লোভনীয়’! অস্ত্র কেনার জন্য বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে রাশিয়া।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে, ২০১৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালেও বাংলাদেশে সেনা হস্তক্ষেপ হয়েছিল।
তবে পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য যেখানে ২০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার লাগবে, সে তুলনায় অস্ত্র চুক্তিটি ছোটই বলা চলে। রোসাটমের তত্ত্বাবধানে রূপপুরে কেন্দ্রের কাজ শুরু করার জন্য শুরুতে ৫০ কোটি ডলার দিচ্ছে রাশিয়া। সব ঠিকঠাক থাকলে বাংলাদেশই হতে যাচ্ছে চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও পাকিস্তানের পর এশিয়ার সপ্তম পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশ।
এবার আসল প্রশ্ন। সত্যিই কি পারমাণবিক বিদ্যুত্ এতটা প্রয়োজন বাংলাদেশে? প্রথম কথা, বাংলাদেশের ব্যাপক জ্বালানি ঘাটতি রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক জরিপমতে, বিদ্যুত্ সুবিধার দিক দিয়ে ১৮৫টি দেশের মধ্যে সবার নিচে বাংলাদেশ—১৮৫তম। দেশটির ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ এখনও বিদ্যুত্ সুবিধার বাইরে রয়েছে।
এ সমস্যার সমাধানে ২ হাজার মেগাওয়াটের পারমাণবিক কেন্দ্র বেশ ভালো উদ্যোগ। এর ফলে একদিকে যেমন দেশের বর্তমান বিদ্যুত্ ঘাটতি দূর হবে, তেমনি ২০২০ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করার লক্ষ্যমাত্রার দিকে বড় এক ধাপ এগিয়ে যাবে সরকার।
দেশের বর্তমান মোট উত্পাদন ক্ষমতা পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার মেগাওয়াট। এ বিদ্যুতের মূল উত্স যে গ্যাস, তারও পর্যাপ্ত রিজার্ভ নেই। এছাড়া সমস্যা সমাধানে অস্থায়ী তেলভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। কয়লা খনি অবশ্য রয়েছে; কিন্তু সেগুলোর ওপর এত মানুষের বসতি যে, উত্তোলন খুবই কঠিন।
তাই পারমাণবিক শক্তিই হতে পারে দেশের বিদ্যুত্ সমস্যার সবচেয়ে বড় সমাধান। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যদিও প্রায় কোনো বিষয়েই একমত হতে পারে না, তারপরও পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে উভয় পক্ষেরই সম্মতি আছে বলে মনে হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ হওয়ায় এ প্রকল্পে পরিবেশগত আরও কিছু সমস্যা আছে। বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছর লেগেই থাকে। কোনো কোনো বছর দেশের দুই-তৃতীয়াংশ পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনে সমস্যা তৈরি হলে বিকল্প জ্বালানির অভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বিদ্যুত্ ব্যবস্থা।
অবশ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মা নদীর তীরে তুলনামূলক নিরাপদ স্থানেই স্থাপন করা হচ্ছে কেন্দ্রটি। বিদ্যুেকন্দ্রের মূল চালিকাশক্তি ইউরেনিয়ামও সরবরাহ করবে রাশিয়াই। তবে তেজস্ক্রিয় এ পদার্থ পরিবহনের সময়ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর যেহেতু রূপপুর ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে, তাই বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতও এর নিরাপত্তা চাইবে।
তবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যে দীর্ঘ রাস্তা পার হয়ে পদ্মার তীরে আসবে ইউরেনিয়াম, সেটি বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক রাস্তা। আবার জনবহুল ঢাকার ভেতর দিয়ে এসব তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিবহন যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনই সময়সাপেক্ষ।
তবে ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে যদি যাতায়াত করতে হয়, তাহলে পদ্মা পার হতে হবে। আর স্থলপথে পদ্মা পার হওয়ার জন্য পদ্মা সেতুর বিকল্প নেই। সুতরাং পদ্মা সেতু না হলে দেশের প্রথম তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলোকে হয়তো বিরাট ঝুঁকি নিয়েই নৌকার মাধ্যমে পদ্মা পার হতে হবে।
সূত্র আমার দেশ।