৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: আরণ্যকের ৪০ বছর পূর্তির নাট্যোৎসবের উদ্বোধনী ও নাট্যকার-নির্দেশক সম্মাননার আয়োজন শেষে শিল্পকলা একাডেমীর মূল মিলনায়তন থেকে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে পরীক্ষণ থিয়েটার হলে ঢুকতে হলো। অন্ধকারের ভেতরে মিলনায়তনে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল মঞ্চসজ্জার দিকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি আগ্রাসনের একটি প্রতীকী অবয়ব ফুটে উঠেছে আফজাল হোসেনের মঞ্চ পরিকল্পনায়।
পঞ্চনারীর আখ্যান ঢাকা থিয়েটারের সাম্প্রতিক প্রযোজনা। এ নাটকে পাঁচটি নারী চরিত্র।সব কটি চরিত্রে একক অভিনয় করেছেন রোজী সিদ্দিকী। মহাভারত-এ পঞ্চপাণ্ডবের আখ্যান রয়েছে, পঞ্চনারীর আখ্যান নাটকে সে রকম মহাকাব্যিক ব্যাপারস্যাপার নেই। মহাভারত-এর পঞ্চপাণ্ডবের এক স্ত্রী দ্রৌপদী। তাঁকে নিয়ে তৈরি একক অভিনয়ের নাটক নাথবতী অনাথবত কিংবা কথা অমৃত সমান। এ দুটি নাটকেরই একক অভিনয়শিল্পী শাঁওলি মিত্র। সেই অসাধারণ প্রযোজনার কথা দর্শকদের মনে পড়তে বাধ্য। অথবা শাঁওলি মিত্রের মা তৃপ্তি মিত্রের একক অভিনয় অপরাজিতাও কি ভোলার মতো? পঞ্চনারীর আখ্যান দেখতে যাওয়ার আগে আরও কয়েকটি একক নাটক ও এগুলোর একক অভিনয়শিল্পীদের কথা দর্শকদের মনে ঘুরে-ফিরে আসবেই। ফেরদৌসী মজুমদারের কোকিলারা, শিমূল ইউসুফের বিনোদিনী, মোমেনা চৌধুরীর লালজমিন কিংবা জ্যোতি সিনহার কহে বীরাঙ্গনা । এ ছাড়া লাকী ইনামের আমি বীরাঙ্গনা বলছি, মুনীরা ইউসুফ মেমীর ফুলরানী আমি টিয়া, নাজনীন হাসান চুমকির সীতার অগ্নিপরীক্ষা—এসব নাটক মাথায় না রেখে পঞ্চনারীর আখ্যান দেখতে বসা মুশকিল।
পঞ্চনারীর আখ্যানের নারীরা হলেন: জোলেখা, অন্তরা, মনোরমা, মরিয়ম ও মমতাজমহল। একমাত্র মমতাজমহল ছাড়া বাকি চার নারী বর্তমান সময়ের কিংবা নিকট অতীতের। সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতারিত, প্রবঞ্চিত ও অবহেলিত এসব নারীর নানা কাহিনি সংবাদপত্রের পাতায় হরহামেশা ছাপা হয়। আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে পুঙ্গব-পৌরুষের নিষ্পেষণে প্রতিনিয়ত রচিত হচ্ছে তাঁদের মতো শতসহস্র নারীর করুণ কাহিনি। আর মমতাজকে খুঁজে পেতে হয় শত শত বছরের পুরোনো ইতিহাসের পাতা থেকে, যদিও উভয় সময়েই পুরুষতন্ত্রের খড়্গর ধার সমান।
পঞ্চনারীর আখ্যান খুব স্বল্প পরিসরে উপস্থাপিত হয়েছে, অনেকটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন কিংবা জীবন্তিকার গড়নে। চরিত্রগুলো হয়তো দর্শককে বিভিন্ন ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, কিন্তু নাট্যক্রিয়ায় ঘটনাপরম্পরার দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ঘাত-প্রতিঘাত ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জীবনের কোনো গভীর উপলব্ধি বা দর্শনকে স্পর্শ করতে কতটা সক্ষম এ প্রযোজনা? ঢাকা থিয়েটার সব সময়ই নতুন ভাবনা ও আঙ্গিকের নাটক দিয়ে দর্শকের রুচি ও মননকে শাণিত করে এসেছে। পঞ্চনারীর আখ্যান কি তার সমান্তরালে অবস্থান নিতে সক্ষম?
মরিয়ম চরিত্রে জামালপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রোজী সিদ্দিকীর সংলাপ প্রক্ষেপণ অতুলনীয়। তবে মরিয়মের আকুতিকে পাশ কাটিয়ে যদি দর্শক আঞ্চলিক ভাষার সংলাপকে মজা হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে নির্দেশকের নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে।
পঞ্চনারীর আখ্যান নাটকের অভিনয়শিল্পী রোজী সিদ্দিকী নিঃসন্দেহে একজন প্রতিভাধর অভিনয়শিল্পী।তাঁর সহজাত অভিনয়নৈপুণ্য এ নাটকের দর্শকমাত্রই অনুভব করবেন। তিনি প্রতিটি সংলাপ দর্শকগ্রাহ্য করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ঘাটতি যদি থেকে থাকে, তা অন্য কোথাও, রোজী সিদ্দিকীর নয়। নাটক দেখতে দেখতে মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, আরও গভীর বোধের কোনো একক নাটক হয়তো রোজীকে দিয়ে উপস্থাপন করানো গেলে অভিনয়শিল্পী হিসেবে দর্শক তাঁকে আবিষ্কার করতেন অনন্য উচ্চতায়; আর সেই নাটক হয়ে উঠতে পারত একটি অসাধারণ প্রযোজনা।
পঞ্চনারীর আখ্যান নাটকটি রচনা করেছেন হারুন রশীদ। নির্দেশনা দিয়েছেন শহীদুজ্জামান সেলিম। সংগীত পরিকল্পনা করেছেন শিমূল ইউসুফ ও চন্দন চৌধুরী। আলোক পরিকল্পনা ও পোশাক পরিকল্পনায় ছিলেন ওয়াসিম আহমেদ ও নাসরিন নাহার।