৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: হাতে লেখা চিঠি তো নেই আর। প্রিয় মানুষের কাছে লেখা চিঠিতে প্রিয় কবির কয়েক ছত্র তুলে দেওয়ার আনন্দটা কি আছে? এ যুগের ছেলেমেয়েরা কি কবিতা পড়ে? নাকি কবিতা আটকে গেল আবৃত্তি সংগঠনগুলোর প্রশিক্ষণ ঘরে?
দিব্যি মনে আছে, একসময় শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণের কবিতা থাকত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের মুখে মুখে। আর রুদ্র কিংবা আবুল হাসান?
কবিতা নিশ্চয়ই মরে যায়নি। কবি টোকন ঠাকুর তো আলাপের শুরুই করলেন এভাবে, ‘যত দিন মানুষের মন থাকবে, প্রেম থাকবে, তত দিন কবিতা থাকবে। তবে ছাপানো কবিতার চেয়ে অনলাইনেই এখন কবিতা বেশি পড়া হয়।’
আসুন, একবার ঘুরে আসি রবীন্দ্রসরোবর থেকে। ওই যে, যে দুই তরুণ শুক্রবার সকালের রোদে স্নান করছেন, তাঁদের সঙ্গেই কথা হোক। একজন হিরণ, অন্যজন হিমেল। শীতের হিমেল হাওয়ায় সিটি কলেজপড়ুয়া হিমেল জানালেন, কবিতার বই কিনে পড়া হয় না। ভেতরে ভেতরে কাব্যচর্চা চলে। গল্প-উপন্যাস পড়া হয়।
চিঠি লেখা হয়?
না। ফেসবুকে লিখি।
বিএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র হিরণ যোগ করেন, ‘কবিতার বই আমারও পড়া হয় না। এখন মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক।’
ঠিক আছে, মেনে নিলাম। কিন্তু যেকোনো একটা কবিতার পঙিক্ত বলুন।
কবিতা স্মরণে আনার প্রাণান্ত চেষ্টা করেন হিরণ-হিমেল। ‘দাঁড়ান, বলছি।’ কিছুক্ষণ পর হতাশ হয়ে দুজনেই বলেন, ‘এই মুহূর্তে মনে করা কষ্টকর।’
শিক্ষার্থীদের আরও কথা শুনব। গন্তব্য এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যাওয়ার পথে প্রকাশকদের কথাগুলো ভাসতে থাকে মনে। দিব্যপ্রকাশের কর্ণধার মইনুল আহসান সাবের বলছিলেন, ‘কবিতা আর ছোটগল্পের বিক্রি পৃথিবীজুড়েই কম। কবিতা পড়তে হলে পাঠককে পাঠক হিসেবে উন্নীত হতে হয়। সেই পর্যায়ের পাঠক কমে গেছে। কাহিনিসর্বস্ব উপন্যাসের দিকেই তারা ঝুঁকছে।’ সময় প্রকাশনের ফরিদ আহমেদও বললেন, ‘এখনকার পাঠকের মন তৈরি নয়। কবিতা পড়ার জন্য যে প্রস্তুতি থাকা দরকার, সেটা নেই।’
ঢুঁ মারি নৃবিজ্ঞান বিভাগে। এ এফ এম জাহিদ হাসান, হাসান মাহমুদ, আবু হান্নান তালুকদাররা একবাক্যে বললেন, ‘আমরা ফেসবুকের স্ট্যাটাসে কাব্যিক শব্দ তো লিখিই। রোমান্টিক কথা লিখি। কিন্তু কবিতা পড়ি না।’
যেকোনো একটি কবিতা মুখস্থ বলতে বলায় বহুক্ষণ মনের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করে একজন বললেন, ‘হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন…’।
পরের লাইন?
নাহ! আর এগিয়ে যেতে পারেন না তাঁরা।
কবি কামরুজ্জামান কামু বলছিলেন, ‘আমি হতাশ নই। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার ব্যাপারে কবিতা থাকছে। অনেক কিছুই কাব্যিক করে বলার চেষ্টা করেন এখনকার তরুণেরা। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কবি মানুষ থাকে। কিন্তু বলা দরকার, পাঠকের কাছ থেকে কবিতা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে। পাঠকের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে কবিতা। সব মানুষ তো কবিতা পড়বে না। কিন্তু যারা পড়তে চায়, তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে কবিতাকে।’
বাংলা বিভাগে একসঙ্গে পেয়ে যাই মাস্টার্সের প্রণয় বিশ্বাস, মো. আলী রেজা, সালাউদ্দিন ইমন, মনির হোসেন, সামছুন নাহার আর সানজিদা ইসলামকে।
আমাকে হতাশ করেননি তাঁরা। সানজিদা ইসলাম বলেন, ‘আমি বলছি না আমাকে ভালোবাসতেই হবে’—তাঁর পরের পঙিক্তটি বলেন মনির হোসেন। প্রিয় কবিদের তালিকায় দেখা গেল পুরোনো কবিরা আছেন শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে। কিন্তু নতুন কবিদের নাম বললেও চিনল না এঁদের কেউ!
টিএসসিতে তেজগাঁও কলেজের নুসাইবা বিনতে সগীর, সিটি কলেজের সানজানা আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের মাহমুদুল হাসান আর ইডেন মহিলা কলেজের নিশি রিমার কাছ থেকে শোনা গেল কিছু কবিতা। ‘সকালে উঠিয়া আমি’, ‘যদি ভালোবাসা পাই তবে শুধরে নেব জীবনের ভুলগুলো’, হে বঙ্গ ভান্ডারে তব,’ ‘আমার মায়ের সোনার নোলক’সহ আরও কিছু কবিতা।
তাহলে কবিতার আশা আছে? এই তো কবি নির্মলেন্দু গুণ বলছিলেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কবিতার পাঠক বাড়েনি। এর মধ্যে গদ্যসাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। তবে আমার কবিতার বই তো বিক্রি হচ্ছে। তরুণেরা ফেসবুকে জানায়, আমার কোন কবিতা সে তার প্রেমিকাকে উপহার দিয়েছে।’
মনে পড়ে যায়, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করা শিক্ষার্থী শহীদুল্লাহ কায়সার বলেছিলেন, ‘এখন আর কবিতা পড়তে ইচ্ছে হয় না। ক্লাস ওয়ান থেকেই তো প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। কবিতা পড়তে বসলেই সবাই হইহই করে উঠত, বলত, কবিতার জায়গায় ইংলিশ গ্রামার পড়। ফলে কবিতা পড়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছে।’
ঐতিহ্য-এর স্বত্বাধিকারী আরিফুর রহমান নাইম বললেন ভয়ংকর কথাটি। ‘এখন কেউ কিছু মনে রাখতে চায় না। মুশকিল আসান গুগল তো রয়েছেই। যা চাও, গুগল কর, ঠিক উত্তরটি পেয়ে যাবে। মনকে দখল করে নিয়েছে যন্ত্র।’
কিন্তু ওই যে টোকন ঠাকুর বলছিলেন, ‘যত দিন প্রেম থাকবে…’ সেটাও তো সত্যি! যন্ত্র হয়ে যাওয়া মনকে আবার প্রেমের ধারায় ফিরিয়ে আনবে তো কবিতাই। হোক সেটা ছাপার অক্ষরে, অথবা কম্পিউটারের মনিটরে।