৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: বইমেলার ভেতরেই অনেক চায়ের স্টল ছিল তখন—আশির দশকের শেষের দিকে, হয়তোনব্বইয়ের প্রথম ভাগে। আমি একনিষ্ঠ কর্মী জাতীয় কবিতা উৎসবের। কবি মহাদেবসাহা, নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে ভালো রকমের পরিচয় হয়ে গেছে। গুণদার পলাশীরবিখ্যাত মেসবাড়ির সিঙ্গেল রুমটায় যাই। মহাদেবদার বাড়ি গেলে নীলা বৌদি মাগুরমাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ান। বুয়েটের হলের ডাইনিংয়ের খাবার খেয়ে চরা পড়েযাওয়া পেটে সেই ঝোল অমৃত বলে মনে হয়। একদিন, বইমেলায়, কড়ইতলার চায়ের স্টলেকবি মহাদেব সাহার পাশে বসে আছি। একটু পরে এলেন কবি শামসুর রাহমান। তারকিছুক্ষণ পরে হুমায়ূন আহমেদ। এই মহামানবদের সঙ্গে বসে আছে প্রকৌশলবিশ্ববিদ্যালয়ের থার্ড ইয়ারের এক ছাত্র, যার ওজন ৫০ কেজি, চোখের নিচে কালি, মাথার চুল উষ্কখুষ্ক, যার বয়স ২৩। কবি ফেরদৌস নাহার এলেন। বললেন, ‘আনিস, তুমি যে একেবারে বড়দের দলে ভিড়ে গেছ।’ লজ্জা পেয়ে উঠে এলাম। সেই হুমায়ূনআহমেদকে আমার প্রথম কাছ থেকে দেখা।
১৯৮৯ সালে আমি পড়ি ফোর্থ ইয়ারে। আমারপ্রথম কবিতার বই খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে বেরিয়ে গেল। বইমেলার ভেতরেইমাদুর বিছিয়ে তখন লিটল ম্যাগাজিন বা নতুন লেখকদের বই বিক্রি করা যেত। আমিওদাঁড়িয়ে পড়লাম। বুয়েটের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে এসে আমার বই কিনতে লাগল। ৪০০কপি বই বিক্রি করে বড়লোক হয়ে গেলাম প্রায়। ওই সময় স্থাপত্য বিভাগের বড় ভাইমাহফুজুর রহমান আমাকে বললেন, ‘দাঁড়াও, তোমার বই স্টলে বিক্রির ব্যবস্থাকরছি। আমার একজন বন্ধুর একটা স্টল আছে।’ গেলাম তাঁর সেই বন্ধুর কাছে। তাঁরনাম আহসান হাবীব। তাঁর দুটো স্টল, উন্মাদ আর দিনরাত্রি প্রকাশনী। আহসানহাবীব ভাই আমার ২০টা বই রাখলেন। বইমেলা শেষে ২০টা বইয়ের দাম বুঝিয়ে দিলেন।সব বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
তিন ভাইয়ের দুই ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো বইমেলায়।
এবারতৃতীয় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের গল্পটা বলতে হয়। মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ততদিনেআমার দু-চারটা বই বেরিয়ে গেছে। সেগুলো বিক্রি হয়। একদিন বইমেলায় আহসানহাবীব ভাই আমাকে বললেন, ‘আপনি একটু দাঁড়ান। মুহম্মদ জাফর ইকবাল আপনাকেদেখতে চেয়েছেন।’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন সায়েন্স ফিকশন লেখক মুহম্মদ জাফরইকবাল। আমি তাঁর সায়েন্স ফিকশন এরই মধ্যে পড়ে ফেলেছি। তিনি যে খুবই ভালোলেখেন, সেটা আমাদের সবার জানা। ভেতরে ভেতরে আমি উত্তেজিত। বাংলা একাডেমীরপুকুরপাড়ের কোনায় আহসান হাবীব ভাইয়ের দিনরাত্রির স্টলে মুহম্মদ জাফর ইকবালএলেন। বললেন, ‘আপনার একটা বই নিয়ে গিয়ে আমি পড়েছি। শাহিনের কাছ থেকে নিয়েগিয়েছিলাম।’
আশ্চর্য যে, বাংলাদেশের বিখ্যাত তিন লেখক ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বইমেলায়!
একদিনহুমায়ূন আহমেদ এলেন মেলায়। ভীষণ ভিড়। তখনো মেলায় তাঁকে ঘিরে ভিড়টা সহনীয়পর্যায়েরই ছিল। আমি তাঁর কাছে গেলাম। মন্তব্য নিলাম। বললাম, ‘আমার মেয়েরজন্য একটা অটোগ্রাফ দেন।’ তিনি লিখলেন, ‘পদ্য, তুমি কেমন আছ?’
এই একলাইনের অটোগ্রাফটার কথা আমি মাঝেমধ্যে ভাবি। আমি হলে লিখতাম, পদ্যকে আদর।এই রকম করে সম্পূর্ণ নতুন কথা এই ভিড়ের মধ্যে যে লেখা যেতে পারে, তা কেবলহুমায়ূন আহমেদই পারেন।
এবারের বইমেলায় আমরা যাব। জাফর স্যার যাবেন, হাবিব ভাই যাবেন। শুধু হুমায়ূন আহমেদ আর যাবেন না।
এবারেরবইমেলা হুমায়ূন আহমেদকে উৎসর্গ করা হচ্ছে। কাজেই তিনি থাকবেন এই বইমেলায়।বিপুলভাবে থাকবেন, থাকবে তাঁর বইগুলো। আর তিনি থাকবেন তাঁর লাখো ভক্তেরহূদয়ে হূদয়ে।
আমি প্রথম বইমেলায় যাই ১৯৮৪ কি ’৮৫ সালে। ২০১৩ পর্যন্ত হিসাব করলে ২৮-২৯ বছর। এরই মধ্যে কত লেখককে আমরা হারালাম।
মৃত্যুরদিন কয়েক আগে আবদুশ শাকুর আমাকে ফোন করলেন, তিনি কলকাতা থেকেফিরেছেন—‘আনিসুল হক, দেবেশ রায় তোমাকে খুঁজছেন। ফোন করো। ফোন নম্বর নাও।’ ফোন নম্বর দিলেন। কণ্ঠস্বর তাঁর ফ্যাসফেসে—সে তো বরাবরই ছিল। কলকাতাগিয়েছিলেন নতুন একটা বইয়ের জন্য গবেষণা করতে। আমার সঙ্গে কথা বলার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি বিদায় নিলেন।
রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই বইমেলায় আসতেনসপারিষদ। আমি তাঁকে আমার নতুন উপন্যাস দিতে গেলাম দৌড়ে। বললাম, ‘দাদাভাই, আমার বই ভালো বিক্রি হয়।’ দাদাভাই বললেন, ‘দেখো, ভালো বিক্রি হওয়া কিন্তুসব সময় ভালো কথা নয়।’ শামসুর রাহমান বইমেলায় এলে আমি তাঁর পেছনে ফেউয়ের মতোঘুরতাম। তাঁর নতুন বই কিনে অটোগ্রাফ নিতাম। তিনি তাঁর সেই ভুবনভোলানোহাসিটা দিতেন।
হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে বইমেলার স্মৃতি অনেক। তিনি ছিলেনআমাদের বইমেলার সবচেয়ে নিয়মিত চরিত্র। রোজ বেলা তিনটায় এসে আগামীর স্টলেবসতেন। তিনি মারাও গেলেন ওই বইমেলা থেকে বেরোনোর পথে আক্রান্ত হওয়ার জেরধরে। তিনি আমাদের বইমেলার শহীদ।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে একবারযে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম কবিতা পড়তে, সেও তোফেব্রুয়ারি মাসে, আর বইমেলা থেকেই। দুই বছরের মধ্যেই তিনি অপ্রকাশিত রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লাহ হয়ে বইমেলায় এলেন। হয়ে গেলেন বার্ষিক রুদ্রমেলা।
কতজনকেইতো মিস করছে আমাদের একুশে বইমেলা—বাংলা একাডেমী চত্বরের বটগাছের পাতা, পুকুরপাড়, বর্ধমান হাউসের খিলানে বাসা বানানো চড়ুই পাখির দল। সিকদার আমিনুলহক, সেই সতত ডানার মানুষটি, মুখে মৃদু হাসি, চোখে কালো চশমা। আবদুলমান্নান সৈয়দ, শিল্পতরুর স্টলে দেখা যেত যাঁকে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যিনিবালক-সাংবাদিকের সাক্ষাৎকারের অনুরোধ হেসেই এড়িয়ে যেতেন। শহীদুল জহিরকিংবা মাহমুদুল হককে আমি বইমেলায় দেখিনি, কিন্তু তাঁরা আর লিখবেন না কোনোদিনও, এই ভার কীভাবে সহ্য করবে আমাদের প্রকাশনা জগৎ? বইমেলার এক প্রাণন্তচরিত্র ছিলেন সমুদ্র গুপ্ত। ঝাঁকড়া সাদা বাবরি চুল নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেনমাঠময়। তারও চেয়ে তরুণ ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। মুখে মৃদু হাসি, লম্বাপাতলা সাদা চুল পাটের আঁশের মতো উড়ছে, কী ঋজু তাঁর চলার ভঙ্গি।
এমনি কতলেখককে হারাল বইমেলা। আনওয়ার আহমেদ আসবেন না রূপম নিয়ে, আসবেন না খন্দকারমাজহারুল করিম তাঁর পেপারব্যাকে লেখা রোমান্টিক সিরিজের বই নিয়ে। ত্রিদিবদস্তিদার চিৎকার করে বলবেন না, ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব।
কিন্তুআসবেন তো সৈয়দ শামসুল হক, আসবে তাঁর বই; আসবেন হাসান আজিজুল হক, আসবে তাঁরগল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী কিংবা প্রবন্ধের বই; আসবেন আনিসুজ্জামান, প্রধানতমোড়ক উন্মোচনের অনুরোধ ফেলতে না পেরে (এ ছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তো বাংলাএকাডেমীর চেয়ারম্যানকে থাকতেই হবে)। আসবেন মুনতাসীর মামুন, সঙ্গে হয়তোশিল্পী হাশেম খান কিংবা শাহরিয়ার কবির, সময় প্রকাশনীতে একবার ঢুঁ মারবেন।আবুল মাল আবদুল মুহিত আসবেন বৈকালিক ভ্রমণের জুতা পরে, দুই হাতে বই কিনবেন।ইমদাদুল হক মিলন আসবেন, বসবেন অনন্যার স্টলে। নাসরীন জাহান আসবেন, ঘুরবেন, ফিরবেন, হয়তো পারভেজ হোসেন থাকবেন তাঁর পাশে। লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুলইসলাম, আহমদ মাযহারকে দেখা যাবে হয়তো চ্যানেল আইয়ের মঞ্চের আশপাশে। মুহম্মদহাবিবুর রহমান আসবেন এক-আধবার, নির্মলেন্দু গুণ আসবেন রাত আটটায়, এক-আধবারআসবেন মহাদেব সাহা। আসাদ চৌধুরী প্রায়ই আসবেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রবিউলহুসাইন, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী কখনো-সখনো। আসাদুজ্জামান নূর ব্যাগভর্তিকরে বই কিনবেন। রামেন্দু মজুমদারকে দেখা যাবে কাউকে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন।দলবেঁধে হাঁটবেন মুহাম্মদ সামাদ কিংবা মোহন রায়হান। মশিউল আলম আড্ডা দেবেনআহমাদ মোস্তফা কামাল কিংবা অদিতি ফাল্গুনীর সঙ্গে। ওয়াসি আহমেদের সামনেতাঁর বই বাড়িয়ে ধরে অটোগ্রাফ চাইলে তিনি লজ্জায় করমচা হয়ে উঠবেন।
আর আসবেন প্রবাসী লেখকেরা।
শামীমআজাদ কিংবা ইকবাল হাসান। সারা দেশ থেকে আসবেন বইপ্রেমী পাঠকেরা। তরুণলেখকেরা। লিটল ম্যাগাজিনের কর্মীরা। হাতে সদ্য ছাপা বই। একটা নতুন পৃথিবীরজন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করবেন তাঁর উদাসীন প্রেমিকা। আজকের বিকালটায়ছেলেটি হয়তো একটু বেশি মনোযোগ লাভের যোগ্য হয়ে উঠেছেন। বটগাছের সবুজ পাতারআড়ালে ডেকে উঠবে কালো কোকিল—হয়তো কালের কোকিল।