আনন্দ-বেদনার বইমেলা

0
182
Print Friendly, PDF & Email

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: বইমেলার ভেতরেই অনেক চায়ের স্টল ছিল তখনআশির দশকের শেষের দিকে, হয়তোনব্বইয়ের প্রথম ভাগেআমি একনিষ্ঠ কর্মী জাতীয় কবিতা উসবেরকবি মহাদেবসাহা, নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে ভালো রকমের পরিচয় হয়ে গেছেগুণদার পলাশীরবিখ্যাত মেসবাড়ির সিঙ্গেল রুমটায় যাইমহাদেবদার বাড়ি গেলে নীলা বৌদি মাগুরমাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ানবুয়েটের হলের ডাইনিংয়ের খাবার খেয়ে চরা পড়েযাওয়া পেটে সেই ঝোল অমৃত বলে মনে হয়একদিন, বইমেলায়, কড়ইতলার চায়ের স্টলেকবি মহাদেব সাহার পাশে বসে আছিএকটু পরে এলেন কবি শামসুর রাহমানতারকিছুক্ষণ পরে হুমায়ূন আহমেদএই মহামানবদের সঙ্গে বসে আছে প্রকৌশলবিশ্ববিদ্যালয়ের থার্ড ইয়ারের এক ছাত্র, যার ওজন ৫০ কেজি, চোখের নিচে কালি, মাথার চুল উষ্কখুষ্ক, যার বয়স ২৩কবি ফেরদৌস নাহার এলেনবললেন, ‘আনিস, তুমি যে একেবারে বড়দের দলে ভিড়ে গেছলজ্জা পেয়ে উঠে এলামসেই হুমায়ূনআহমেদকে আমার প্রথম কাছ থেকে দেখা
১৯৮৯ সালে আমি পড়ি ফোর্থ ইয়ারেআমারপ্রথম কবিতার বই খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে বেরিয়ে গেলবইমেলার ভেতরেইমাদুর বিছিয়ে তখন লিটল ম্যাগাজিন বা নতুন লেখকদের বই বিক্রি করা যেতআমিওদাঁড়িয়ে পড়লামবুয়েটের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে এসে আমার বই কিনতে লাগল৪০০কপি বই বিক্রি করে বড়লোক হয়ে গেলাম প্রায়ওই সময় স্থাপত্য বিভাগের বড় ভাইমাহফুজুর রহমান আমাকে বললেন, ‘দাঁড়াও, তোমার বই স্টলে বিক্রির ব্যবস্থাকরছিআমার একজন বন্ধুর একটা স্টল আছেগেলাম তাঁর সেই বন্ধুর কাছেতাঁরনাম আহসান হাবীবতাঁর দুটো স্টল, উন্মাদ আর দিনরাত্রি প্রকাশনীআহসানহাবীব ভাই আমার ২০টা বই রাখলেনবইমেলা শেষে ২০টা বইয়ের দাম বুঝিয়ে দিলেনসব বিক্রি হয়ে গিয়েছিল
তিন ভাইয়ের দুই ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো বইমেলায়
এবারতৃতীয় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের গল্পটা বলতে হয়মুহম্মদ জাফর ইকবালততদিনেআমার দু-চারটা বই বেরিয়ে গেছেসেগুলো বিক্রি হয়একদিন বইমেলায় আহসানহাবীব ভাই আমাকে বললেন, ‘আপনি একটু দাঁড়ানমুহম্মদ জাফর ইকবাল আপনাকেদেখতে চেয়েছেনযুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন সায়েন্স ফিকশন লেখক মুহম্মদ জাফরইকবালআমি তাঁর সায়েন্স ফিকশন এরই মধ্যে পড়ে ফেলেছিতিনি যে খুবই ভালোলেখেন, সেটা আমাদের সবার জানাভেতরে ভেতরে আমি উত্তেজিতবাংলা একাডেমীরপুকুরপাড়ের কোনায় আহসান হাবীব ভাইয়ের দিনরাত্রির স্টলে মুহম্মদ জাফর ইকবালএলেনবললেন, ‘আপনার একটা বই নিয়ে গিয়ে আমি পড়েছিশাহিনের কাছ থেকে নিয়েগিয়েছিলাম
আশ্চর্য যে, বাংলাদেশের বিখ্যাত তিন লেখক ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বইমেলায়!
একদিনহুমায়ূন আহমেদ এলেন মেলায়ভীষণ ভিড়তখনো মেলায় তাঁকে ঘিরে ভিড়টা সহনীয়পর্যায়েরই ছিলআমি তাঁর কাছে গেলামমন্তব্য নিলামবললাম, ‘আমার মেয়েরজন্য একটা অটোগ্রাফ দেনতিনি লিখলেন, ‘পদ্য, তুমি কেমন আছ?’
এই একলাইনের অটোগ্রাফটার কথা আমি মাঝেমধ্যে ভাবিআমি হলে লিখতাম, পদ্যকে আদরএই রকম করে সম্পূর্ণ নতুন কথা এই ভিড়ের মধ্যে যে লেখা যেতে পারে, তা কেবলহুমায়ূন আহমেদই পারেন
এবারের বইমেলায় আমরা যাবজাফর স্যার যাবেন, হাবিব ভাই যাবেনশুধু হুমায়ূন আহমেদ আর যাবেন না
এবারেরবইমেলা হুমায়ূন আহমেদকে উসর্গ করা হচ্ছেকাজেই তিনি থাকবেন এই বইমেলায়বিপুলভাবে থাকবেন, থাকবে তাঁর বইগুলোআর তিনি থাকবেন তাঁর লাখো ভক্তেরহূদয়ে হূদয়ে
আমি প্রথম বইমেলায় যাই ১৯৮৪ কি ৮৫ সালে২০১৩ পর্যন্ত হিসাব করলে ২৮-২৯ বছরএরই মধ্যে কত লেখককে আমরা হারালাম
মৃত্যুরদিন কয়েক আগে আবদুশ শাকুর আমাকে ফোন করলেন, তিনি কলকাতা থেকেফিরেছেন—‘আনিসুল হক, দেবেশ রায় তোমাকে খুঁজছেনফোন করোফোন নম্বর নাওফোন নম্বর দিলেনকণ্ঠস্বর তাঁর ফ্যাসফেসেসে তো বরাবরই ছিলকলকাতাগিয়েছিলেন নতুন একটা বইয়ের জন্য গবেষণা করতেআমার সঙ্গে কথা বলার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি বিদায় নিলেন
রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই বইমেলায় আসতেনসপারিষদআমি তাঁকে আমার নতুন উপন্যাস দিতে গেলাম দৌড়েবললাম, ‘দাদাভাই, আমার বই ভালো বিক্রি হয়দাদাভাই বললেন, ‘দেখো, ভালো বিক্রি হওয়া কিন্তুসব সময় ভালো কথা নয়শামসুর রাহমান বইমেলায় এলে আমি তাঁর পেছনে ফেউয়ের মতোঘুরতামতাঁর নতুন বই কিনে অটোগ্রাফ নিতামতিনি তাঁর সেই ভুবনভোলানোহাসিটা দিতেন
হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে বইমেলার স্মৃতি অনেকতিনি ছিলেনআমাদের বইমেলার সবচেয়ে নিয়মিত চরিত্ররোজ বেলা তিনটায় এসে আগামীর স্টলেবসতেনতিনি মারাও গেলেন ওই বইমেলা থেকে বেরোনোর পথে আক্রান্ত হওয়ার জেরধরেতিনি আমাদের বইমেলার শহীদ
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে একবারযে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম কবিতা পড়তে, সেও তোফেব্রুয়ারি মাসে, আর বইমেলা থেকেইদুই বছরের মধ্যেই তিনি অপ্রকাশিত রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লাহ হয়ে বইমেলায় এলেনহয়ে গেলেন বার্ষিক রুদ্রমেলা
কতজনকেইতো মিস করছে আমাদের একুশে বইমেলাবাংলা একাডেমী চত্বরের বটগাছের পাতা, পুকুরপাড়, বর্ধমান হাউসের খিলানে বাসা বানানো চড়ুই পাখির দলসিকদার আমিনুলহক, সেই সতত ডানার মানুষটি, মুখে মৃদু হাসি, চোখে কালো চশমাআবদুলমান্নান সৈয়দ, শিল্পতরুর স্টলে দেখা যেত যাঁকেআখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যিনিবালক-সাংবাদিকের সাক্ষাকারের অনুরোধ হেসেই এড়িয়ে যেতেনশহীদুল জহিরকিংবা মাহমুদুল হককে আমি বইমেলায় দেখিনি, কিন্তু তাঁরা আর লিখবেন না কোনোদিনও, এই ভার কীভাবে সহ্য করবে আমাদের প্রকাশনা জগ? বইমেলার এক প্রাণন্তচরিত্র ছিলেন সমুদ্র গুপ্তঝাঁকড়া সাদা বাবরি চুল নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেনমাঠময়তারও চেয়ে তরুণ ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরীমুখে মৃদু হাসি, লম্বাপাতলা সাদা চুল পাটের আঁশের মতো উড়ছে, কী ঋজু তাঁর চলার ভঙ্গি
এমনি কতলেখককে হারাল বইমেলাআনওয়ার আহমেদ আসবেন না রূপম নিয়ে, আসবেন না খন্দকারমাজহারুল করিম তাঁর পেপারব্যাকে লেখা রোমান্টিক সিরিজের বই নিয়েত্রিদিবদস্তিদার চিকার করে বলবেন না, ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব
কিন্তুআসবেন তো সৈয়দ শামসুল হক, আসবে তাঁর বই; আসবেন হাসান আজিজুল হক, আসবে তাঁরগল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী কিংবা প্রবন্ধের বই; আসবেন আনিসুজ্জামান, প্রধানতমোড়ক উন্মোচনের অনুরোধ ফেলতে না পেরে (এ ছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তো বাংলাএকাডেমীর চেয়ারম্যানকে থাকতেই হবে)আসবেন মুনতাসীর মামুন, সঙ্গে হয়তোশিল্পী হাশেম খান কিংবা শাহরিয়ার কবির, সময় প্রকাশনীতে একবার ঢুঁ মারবেনআবুল মাল আবদুল মুহিত আসবেন বৈকালিক ভ্রমণের জুতা পরে, দুই হাতে বই কিনবেনইমদাদুল হক মিলন আসবেন, বসবেন অনন্যার স্টলেনাসরীন জাহান আসবেন, ঘুরবেন, ফিরবেন, হয়তো পারভেজ হোসেন থাকবেন তাঁর পাশেলুফর রহমান রিটন, আমীরুলইসলাম, আহমদ মাযহারকে দেখা যাবে হয়তো চ্যানেল আইয়ের মঞ্চের আশপাশেমুহম্মদহাবিবুর রহমান আসবেন এক-আধবার, নির্মলেন্দু গুণ আসবেন রাত আটটায়, এক-আধবারআসবেন মহাদেব সাহাআসাদ চৌধুরী প্রায়ই আসবেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রবিউলহুসাইন, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী কখনো-সখনোআসাদুজ্জামান নূর ব্যাগভর্তিকরে বই কিনবেনরামেন্দু মজুমদারকে দেখা যাবে কাউকে অটোগ্রাফ দিচ্ছেনদলবেঁধে হাঁটবেন মুহাম্মদ সামাদ কিংবা মোহন রায়হানমশিউল আলম আড্ডা দেবেনআহমাদ মোস্তফা কামাল কিংবা অদিতি ফাল্গুনীর সঙ্গেওয়াসি আহমেদের সামনেতাঁর বই বাড়িয়ে ধরে অটোগ্রাফ চাইলে তিনি লজ্জায় করমচা হয়ে উঠবেন
আর আসবেন প্রবাসী লেখকেরা
শামীমআজাদ কিংবা ইকবাল হাসানসারা দেশ থেকে আসবেন বইপ্রেমী পাঠকেরাতরুণলেখকেরালিটল ম্যাগাজিনের কর্মীরাহাতে সদ্য ছাপা বইএকটা নতুন পৃথিবীরজন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করবেন তাঁর উদাসীন প্রেমিকাআজকের বিকালটায়ছেলেটি হয়তো একটু বেশি মনোযোগ লাভের যোগ্য হয়ে উঠেছেনবটগাছের সবুজ পাতারআড়ালে ডেকে উঠবে কালো কোকিলহয়তো কালের কোকিল

 

শেয়ার করুন