ঢাকা,(৪ফেব্রুয়ারী) : মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে মঙ্গলবার। চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় দেবেন।
সোমবার দুপুরে প্রেস ব্রিফিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদেরকে এ তথ্য জানান ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার একেএম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ। বেলা পৌণে একটায় সংক্ষিপ্ত ব্রিফ করেন তিনি।
রেজিস্ট্রার একেএম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠনের পর থেকে এটি হচ্ছে দ্বিতীয় মামলার রায়। রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে আমরা কোনো নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছি না। মঙ্গলবার যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা রেখেই রায় ঘোষিত হবে।’’
এর আগে সকালে বাংলানিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।
গত ১৭ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া। ওই দিন যে কোনো দিন মামলার রায় দেওয়া হবে বলে অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন চেয়ারম্যান ট্রাইব্যুনাল।
এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছেন ট্রাইব্যুনাল-২। এর আগে গত ২১ জানুয়ারি একই ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে পলাতক জামায়াতের সাবেক রোকন (সদস্য) আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। অন্যদিকে প্রথম ট্রাইব্যুনালে গত ২৯ জানুয়ারি শেষ হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে অপর অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া। এ মামলার রায়ও যেকোনো দিন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১।
পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ গত ৭ জানুয়ারি শুনানি শেষে কাদের মোল্লার মামলা পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। সে আদেশে পুনর্বিচারের আবেদন করার আগে মামলাটি যে পর্যায়ে ছিল, সেখান থেকেই শুরু করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরুর মধ্য দিয়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে পৌঁছে।
উল্লেখ্য, মামলার রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়ে যাওয়ার পর গত ৩ জানুয়ারি মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল আমীন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস প্রবাসী বাংলাদেশি আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল-১ এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে এ আবেদন করেন আসামিপক্ষ।
ওই স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে বিচারাধীন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা ৪টিরও পুনরায় শুরু করার আবেদন গত ৩ জানুয়ারি খারিজ করে দেন দু’টি ট্রাইব্যুনাল। আর এ আদেশের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয় গত ২১ জানুয়ারি।
অন্যদিকে একই ঘটনার সূত্র ধরে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাশাপাশি পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালও। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর প্রথম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন এ ট্রাইব্যুনালেরই বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম
মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম মোস্তফা নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কেরাণীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলাটি করেছিলেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এই মামলার প্রথম সাক্ষী মোস্তফার কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ খান। ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদের মোল্লাসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে। ওই মামলার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে ট্রাইব্যুনাল-১ এ যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় ২০১০ সালের ২১ জুলাই।২০১১ সালের ১ নভেম্বর জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) তার বিরুদ্ধে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। ২৮ ডিসেম্বর এসব অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।
গত বছরের ১৬ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাসহ তিনটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।
গত বছরের ২৮ মে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানিসহ ৬টি অভিযোগ এনে কাদের মোল্লার বিরদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৩(১), ৩(২)(এ)(এইচ) অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। গত বছরের ২০ জুন তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও সুলতান মাহমুদ। তারা ৯৬ পৃষ্ঠার এ সূচনা বক্তব্যে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
এর পর ৩ জুলাই থেকে শুরু করে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খান ও মনোয়ারা বেগমসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১২ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদেরকে জেরা করেন।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া রাষ্ট্রপক্ষের অন্য সাক্ষীরা হলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহম্মেদ খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মামা বাহিনীর প্রধান ও কমান্ডার শহিদুল হক খান মামা, কাদের মোল্লার হাতে ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), কবি কাজী রোজি, শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ও আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবের পুত্র সরকারি কর্মকর্তা খন্দকার আবুল আহসান, সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী সাফিউদ্দিন মোল্লা, আব্দুল মজিদ পালোয়ান, কেরাণীগঞ্জের ঘাটারচর গ্রামের শহীদ নবী হোসেন বুলুর স্ত্রী নূরজাহান বেগম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা এবং সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম।
অন্যদিকে ১৫ নভেম্বর থেকে শুরু করে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাদের মোল্লা নিজেসহ ৬ জন সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পক্ষে। এর আগে ৪ নভেম্বর সাফাই সাক্ষীর জন্য আসামীপক্ষের দাখিল করা ৯৬৫ জনের তালিকা থেকে ৬জন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অনুমোদন করেন ট্রাইব্যুনাল। অন্য ৫ সাফাই সাক্ষী হচ্ছেন, সুশীল চন্দ্র মণ্ডল, মোসলেম উদ্দিন মাস্টার, সাহেরা খাতুন, আলতাফ উদ্দিন মোল্লা ও এ আই এম লোকমান। রাষ্ট্রপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেন।
গত ৭ থেকে ১৭ জানুয়ারি মোট ৮ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আসামিপক্ষ। এর মধ্যে কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ৪ দিন এবং অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস সোবহান তরফদার ৪ দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। অন্যদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী গত বছরের ১৭ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ও গত ১৬ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রপক্ষও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে সময় নেন ৮ কার্যদিবস।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, কবি মেহেরুন্নেছাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, পল্লবীর আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা, আইনজীবী-সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা, বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা, কেরাণীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের ভাওয়াল খান বাড়ি ও ঘাটারচরসহ পাশের আরো দু’টি গ্রামের অসংখ্য লোককে হত্যার ঘটনা।
নিউজরুম