বয়স আমার ৬০। সরকারি চাকরি করতাম। এখন রিটায়ার করা জীবন আমার। বাড়ি আছে শহরতলিতে। শহরের মাঝখানে দুই কাঠা জমিও আছে। গাড়ি কিনব-কিনব করছি। ভরভরন্ত সংসার। আমার চারদিকে পুত্রক-ন্যারা। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা হওয়ার কথা। আমার স্ত্রীর বেলায় ওই নিয়ম খাটেনি। ৫০ পেরিয়ে গেলেও তার শরীরের বাঁধন এখনো অটুট। ফরসা রং তার, চামড়ার মসৃণতা অন্য নারীর মনে হিংসা জাগায়। চুল আমার ধবধবে সাদা। আমার স্ত্রীর মাঝেমধ্যে দু-এক গাছি চুল পাকলেও ত্বরিত বুয়াকে দিয়ে মূলোৎপাটন করে। স্ত্রীর পাশে নিজেকে বড় বুড়ো বুড়ো মনে হয়। আমার সবকিছু আছে, কিন্তু কী যেন নেই। ভরা আনন্দের সময়েও মন খচখচিয়ে ওঠে, কী যেন এক গভীর অতৃপ্তি আমার মনকে চঞ্চল করে তোলে। চেহারায় বোধ হয় এই চাঞ্চল্যের প্রভাব পড়ে। মাঝেমধ্যে আমার স্ত্রী জিগ্যেস করে, ‘তোমাকে এত অস্থির লাগছে কেন? শরীর কি খারাপ করেছে?’ আমি মুখ ফিরিয়ে ঢোঁক গিলে বলি, কই, না তো? স্ত্রী প্রসঙ্গান্তরে যায়। মা-বাবার পছন্দের মেয়েটিকেই বিয়ে করেছিলাম আমি।গত ৩৫ বছর ও সোহাগে আর যত্নে আমাকে ভরিয়ে রেখেছে। স্নানে নিজ হাতে গরম জল এগিয়ে দিয়েছে, রাতের বেলা মাথায় তেল ঘষে দিয়েছে। ভালো রান্নাগুলো আমার পাতে তুলে দিয়ে পরম তৃপ্তি পেতে দেখেছি তাকে। তার পরও আমার ভেতরে সুখ নেই। একটা গভীর বেদনাকে আমি আমার মধ্যে গত ৩৫ বছর লালন করে আসছি। এই বেদনার কথা আমি কাউকে বলতে পারিনি। কাকে বলব? পুত্র-কন্যা-স্ত্রী—কাউকে বলা যাবে না এ কষ্টের কথাটি। তাহলে যে সংসারে বিপর্যয় ঘটবে। দীর্ঘদিন নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করতে করতে রক্তাক্ত হয়েছি। অনেক অনেক বছর অভিনয় করে গেছি স্ত্রীর সঙ্গে, পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে। আর পারছি না আমি। আমার বেদনার কথা কারও সঙ্গে শেয়ার করতে না পারলে আমার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। তাই ঠিক করেছি, এই শেষবিকেলে জীবনের আলোকময় সকালের কথাগুলো একটু লিখে জানাব। এতে হয়তো আমার অপরাধবোধ কমবে। যাকে নিয়ে আমার উজ্জ্বল সকাল জড়ানো, সে যদি আমার এ লেখাটি পড়ে, তাহলে অনেক অভিমানের ভেতরে থেকেও সে আমাকে ক্ষমা করার ব্যাপারটি একটু করে হলেও হয়তো ভেবে দেখবে।
এইচএসসি পাস করার পর নরসিংদী সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। ৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে সেবারই প্রথম অনার্স ক্লাস শুরু হয়েছিল বাংলা বিভাগে। আমাদের ক্লাসে ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা বেশি। আমরা জনা পাঁচেক ছেলে ছিলাম। হাসান, রফিক, সুখেন্দু চক্রবর্তী, দোর্দণ্ডপ্রতাপ বড়ুয়া আর আমি। আমি হিমাংশু দাশ। আমার পদবি দাশ হলে কী হবে, আসলে আমরা ছিলাম শীল। পদবি পাল্টালেও জাতপেশা থেকে গিয়েছিল আমাদের। গ্রামের বাজারে চুলকাটার দোকান ছিল আমাদের। বাবা সেখানে ক্ষৌরকর্ম করতেন। ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করার বেদনায় সব সময় জড়সড় থাকতাম আমি। হাসান, রফিক, সুখেন্দু শহরেরই ছেলে। দোর্দণ্ড শহরতলি থেকে এলেও ইঁচড়েপাকা ছিল সে। তার সব ভাবনা আর আলোচনার বিষয় ছিল নারী-পুরুষের শরীর নিয়ে। রফিক খুব পড়ুয়া ছিল।তার হাতে সর্বদা পাঠ্যবহির্ভূত বই থাকত। হাসান বাঁ হাতে সিগারেট গুঁজে কী যেন ভাবত সব সময়। সুখেন্দু ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান। অন্যের কীভাবে উপকার হয়, এই চিন্তায় মশগুল থাকত সে। আর আমি? মাটির গন্ধ গায়ে মেখে গ্রাম থেকে উঠে এলে একজন তরুণের যে অবস্থা হয়, আমারও সেরকম।
মেয়েদের মধ্যে শরিফা খলবলিয়ে কথা বলত। রেশমা ভালো নাচতে পারত; কোনো রকমে ক্লাস শেষ করে সে নাচের ক্লাসে চলে যেত। নাবিলা ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে গুনগুনিয়ে গান করত। কস্তুরি ছিল সংসারমগ্ন। এসএসসির পর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তার। সন্তান, স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি—এসবের ভেতরে থেকেও সে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তার চোখেমুখে সংসার, ক্লান্তির ছাপ। সহপাঠীদের মধ্যে আরেকজন ছিল মাধবীলতা দত্ত। বেঞ্চের শেষ প্রান্তে বসত। সে ছিল ভীষণ রকমের চুপচাপ। উজ্জ্বল শ্যামলা রং তার, মাঝারি হাইট। চোখ দুটি অলৌকিক, মায়া মায়া। অধর প্রশস্ত, সামান্য ঝুলানো। ওই অধরেই নারীর সব সৌন্দর্য ও পুরুষের সব বাসনা যেন জড়ো হয়ে ছিল।
সুখেন্দুর চোখ পড়েছিল মাধবীলতার ওপর। ক্লাসে আমার পাশেই বসত সুখেন্দু। শিক্ষকের লেকচারের ফাঁকে ফাঁকে কোমল চোখে মাধবীর দিকে তাকাত সে। মাধবী তখন গভীর মনোযোগে শিক্ষকের কথা শুনছে। অন্য সময়ে মাধবীর আশপাশে ঘুর-ঘুর করত সুখেন্দু। মাধবীকে জিগ্যেস করত, ‘আজ স্যার ক্ষেত্রগুপ্তের যে বইটির কথা বললেন, ওটি তোমার কাছে আছে কি না? না থাকলে আমি তোমাকে দিতে পারি। আমার কাছে আছে।’ অথবা ‘আগামী সপ্তাহে তো মেঘনাদবধ কাব্যের প্রমীলা চরিত্রের ওপর টিউটোরিয়াল পরীক্ষা, নোটটা তৈরি করেছ কি তুমি? না করলে আমি সাহায্য করতে পারি?’
মাধবী স্মিত হেসে বলত, ‘দাদা, বইটি আমার কাছে আছে। আর নোটটি আমি বেশ কিছুদিন আগে রেডি করেছি।’
ম্লান মুখে সুখেন্দু ফিরে আসত। আমাকে বলত, ‘দেখছস, দেমাক দেখছস? বলে সাহায্যের দরকার নেই, বলে কি জানো? আমি বলে দাদা!’
আমি উসখুসে মুখে সুখেন্দুর দিকে তাকাতাম। সুখেন্দু আমাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী। দীর্ঘদেহী। তবে তার চেহারায় একটি অগুণ ছিল। বয়স্ক না হয়েও বয়সের একটা ছাপ তার সব অবয়বে ছড়িয়ে ছিল। তার চেহারায় দাদা দাদা একটা ভাব ছিল। তাই ক্লাসের প্রায় সব মেয়ে তাকে দাদা বলে সম্বোধন করত। এটা আবার সুখেন্দুর সহ্য হতো না। রাগী কণ্ঠে বলত, ‘দাদা, কেন? প্রেমিক হওয়ার যোগ্যতা কি আমার নেই?’
সেদিন মাধবীর দাদা সম্বোধন শুনে এসে আমার পাশে বসল সুখেন্দু।চাপা স্বরে বলল, ‘দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। দাদা ডাকার লেসন দিচ্ছি। সুখেন্দুর হস্তাক্ষর ছিল অসাধারণ সুন্দর! তার সুন্দর হাতের লেখার জন্যই শুধু তাকে ভালোবাসা যেত।
সপ্তাহ খানেক কেটে গেল। একদিন সিঁড়িতে দেখা মাধবীর সঙ্গে। আমার সামনে একটুক্ষণ যেন থমকে দাঁড়াল মাধবী! আমার ভুলও হতে পারে।এটা যে ভুল নয়, পরের দিন টের পেলাম। সেদিন শেষ পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর হই হই করে প্রায় সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। মাধবী আমার সামনে এসে দাঁড়াল। সাদা একটি খাম এগিয়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘খুব সাহসী তুমি।’ বলেই ক্লাসের বাইরে চলে গেল মাধবী। আমি কাঁপা হাতে খামটি ধরে সেই নির্জন ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর প্রায় ধপাস করে বেঞ্চে বসে পড়লাম। গ্রামের ছেলে আমি।শহুরে হালচালের সঙ্গে খুব ভালো করে পরিচিত হয়ে উঠিনি। বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। এ কিসের খাম? মাধবী কেনই বা বলল ‘খুব সাহসী তুমি’। বেশ কিছুক্ষণ পর বুকের কাঁপন থামলে খামটি খুললাম আমি। দেখি ভেতরে একটি চিঠি। কোনো সম্বোধন নেই। সরাসরি লেখা: ‘তোমাকে দেখতে ভেজা বিড়ালের মতো মনে হলেও, দুঃসাহসী তুমি? সরাসরি চিঠি দিলে তুমি আমাকে? তাও আবার প্রিয় মাধবী বলে। মুখে তো তেমন করে গুছিয়ে কথা বলতে পারো না। তোমার জিবে ও আচরণে গ্রামীণতা জড়ানো।কিন্তু চিঠি তো লিখেছ বেশ খাসা! এমন অসাধারণ সুন্দর হাতের লেখা তোমার! আহা! তোমার হাতের লেখার অর্ধেক সুন্দরও যদি আমার লেখা হতো! কালকে ছুটির পর থেকে যেয়ো, কথা আছে।’
কী আশ্চর্য! আমার হাতের লেখা আবার সুন্দর হলো কখন? কোনো রকমে আমার হাতের লেখা বোঝা যায় মাত্র। লেখা তো সুন্দর সুখেন্দুর! আর আমি কখন মাধবীকে চিঠি লিখলাম? কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে তাকানোর সাহসটি পর্যন্ত নেই যার, তার আবার চিঠি লেখা! বড় দ্বিধায় পড়ে গেলাম আমি। মাধবীর চিঠির মর্মার্থ বুঝতে পারলাম না। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে বাড়ি ফিরলাম আমি।
পরদিন সেমিনারকক্ষের সামনে কাঁধে বিরাট একটা থাপড় খসিয়ে সুখেন্দু বলল, ‘কীরে হিমাংশু, কেমন লাগছে তোর? তোর মুখের রং তো পাল্টে গেছে রে?’
মানে? নিচু স্বরে বললাম।
‘মানে, মানে কীরে বেটা? চিঠির উত্তর পাসনি?’ চাপা স্বরে জিগ্যেস করল সুখেন্দু।
এতক্ষণে আমার কাছে সবকিছু খোলাসা হয়ে গেল। তাহলে চিঠি সুখেন্দুই লিখেছে মাধবীকে, আমার নাম দিয়ে। আমি সুখেন্দুকে টানতে টানতে ক্যানটিনে নিয়ে গেলাম।চা-শিঙাড়ার অর্ডার দিয়ে জিগ্যেস করলাম, সুখেন, ঘটনাটা খুলে বল তো ভাই।
চা খেতে খেতে সুখেন্দু জানায়, চিঠির ইতিতে আমার নাম ব্যবহার করে প্রেমের চিঠি গছিয়েছে সে মাধবীকে। দাদা ডাকার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে এ কাজ করেছে।চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে সুখেন্দু বলল, ‘দত্তের এবার দেমাক ভাঙবে।’ সুখেন্দু আমার জাতপাতের বিষয়টি জানত।
এরপর আমাদের অন্য রকম একটা জীবন শুরু হয়ে গেল। আমাদের মানে আমার আর মাধবীর। ক্লাস ফাঁকি দেওয়া শুরু হলো আমাদের।আজকে মেঘনা নদীর পাড়ে তো পরশু চৈতন্যার বনে। কখনো সকালের ট্রেনে বসে পড়া; ঘোড়াশাল স্টেশনে নেমে এধার-ওধার ঘোরা। অন্য সহপাঠিনীরা সালোয়ার-কামিজ পরলেও শাড়ি পরত মাধবী। শাড়িতে তাকে অসাধারণ লাগত! তাকে ঘিরে আমার অলৌকিক স্বপ্ন দানা বাঁধতে থাকত! আমাদের এ ভালোবাসাবাসিতে শরীর ছিল না। একটু হাত ধরাধরি, একটু কাছ ঘেঁষে বসা—এই-ই ছিল আমাদের প্রেম। ক্লাসমেটরা আড়েঠারে তাকাত আমাদের দিকে। আমাদের প্রেমের ব্যাপারটি ডিপার্টমেন্টে চাউর হয়ে গিয়েছিল।দু-একজন শিক্ষকের কানেও যে গেছে, তা টের পেয়েছিলাম পরে।
বিভাগ থেকে রাঙামাটিতে বনভোজনে গেলাম। প্রায় ১০০ জন শিক্ষার্থী আর পাঁচ-সাতজন শিক্ষক-শিক্ষিকা। রাঙামাটিতে আমরা একটু আড়াল খুঁজছিলাম। দু-চারটা গাছ পেরিয়ে একটু সামনে গেছি মাত্র দুজনে, অমনি সিরাজ স্যারের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘কীরে, কোথায় যাও দুজনে? দূরে যেয়ো না। আসো আসো।’
তখন আমরা থার্ড ইয়ারে উঠে গেছি। বাংলা বিভাগের দেয়াল পত্রিকায় আমার একটি কবিতা ছাপা হলো।কবিতার বিষয়বস্তু তেমন বিশেষ কিছু না। সিরাজ স্যার খুব জ্বালাতেন আমাদের।সাদা চুল-দাড়িতে মেহেদি লাগাতেন তিনি। কবিতায় তাঁকেই টার্গেট করলাম আমি।লিখলাম—
চুল-দাড়ি পাকিয়াছে, মন পাকে নাই,
মনে যার থাকিবার, সে তো থাকে নাই;
তাই চুল-দাড়ি পাকিয়াছে মন পাকে নাই।
—ইত্যাদি।
স্যারের চোখে পড়েছিল কি না জানি না, কিন্তু বিভাগের নানা ইয়ারের শিক্ষার্থীদের নজর কেড়েছিল কবিতাটি। একদিন ফার্স্ট ইয়ারের একজন ছাত্রী এগিয়ে এসে কবিতাটির খুব তারিফ করল। আমি মিষ্টি হেসে সৌজন্য দেখালাম। আমি সরে গেলাম তার কাছ থেকে। কিন্তু নাদিয়া ইয়াসমিন আমার পিছু ছাড়ল না। কারণে-অকারণে আমার সামনে এসে দাঁড়াতে লাগল। তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো, ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলা—এসব কিছুতে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলো। সবচেয়ে বেশি ভুল বুঝল মাধবী।
একদিন মাধবী বলে ফেলল, ‘এসব কী হচ্ছে?’
আমি বললাম, কী বিষয়ে বলছ তুমি?
‘ওই যে নাদিয়া ইয়াসমিন, তার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলার প্রয়োজন কী?’ বলল মাধবী।
আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকালাম। দেখলাম, তার চোখেমুখে সন্দেহ আর ঘৃণার মাখামাখি! আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, ও কবিতা ভালোবাসে। মাঝেমধ্যে কবিতা নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া তো বেশি কিছু না। তারপর স্পষ্ট গলায় বললাম, তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো?
‘সন্দেহ নয়। কানাঘুষা চলছে ডিপার্টমেন্টে। নানা রকম নোংরা কথা কানে আসছে। তুমি স্পষ্ট করে নাদিয়াকে বলে দাও, যাতে ও আর তোমার সঙ্গে না মেশে।’ মাধবী বলল।
আমি খুব আহত হলাম! মাধবী এ কী বলছে! এত নিবিড় ভালোবাসা তার সঙ্গে আমার! বিশ্বাসের ওপর আমাদের ভালোবাসা দাঁড়ানো বলে এত দিন আমি বিশ্বাস করতাম। কিন্তু মাধবীর আজকের কথাতে তো তা প্রকাশ পাচ্ছে না! ভেতরটা আমার জ্বলে যেতে লাগল। আমাদের ভালোবাসার অপমানে আমি মর্মাহত হলাম।
একধরনের ব্যথা আর ক্রোধ আমার মধ্যে চাগিয়ে উঠল। আমি বললাম, অযথা সন্দেহ কোরো না। ভালোবাসার অপমান কোরো না।
নাদিয়ার কানেও বোধ হয় কানাঘুষার কথাটি গিয়েছিল। তার হয়তো জেদ চেপে গিয়েছিল, নইলে কেন সে আরও বেশি করে আমাকে আঁকড়ে ধরল? এর পর থেকে সে আমার চারপাশে আরও বেশি করে ঘুর-ঘুর করতে লাগল। ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলতে লাগল। নাদিয়া যত কাছে এল, মাধবী তত দূরে সরে গেল। নাদিয়াকে আকারে-ইঙ্গিতে বার কয়েক বললাম আমার সঙ্গ ছাড়তে, কিন্তু সে আরও বেশি করে সাপে ব্যাঙ গিলার মতো করে আমাকে গিলতে লাগল।মাধবীকে বোঝালাম, ও শুনে দূর থেকে আরও দূরে সরে যেতে লাগল। একটা সময় সে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। ধীরে ধীরে ও এবং আমার মধ্যে কঠিন একটা দেয়াল তৈরি হয়ে গেল! আমরা একই ক্লাসে পড়ি। কিন্তু কারও দিকে কেউ তাকাই না।এমনি করে দুজনে একটি নদীর দুই পারের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। দীর্ঘশ্বাসকে সম্বল করে থার্ড ইয়ার ফাইনাল দিলাম। কোনো রকমে সেকেন্ড ক্লাস পেলাম আমি।মাধবী ভালো পজিশন নিয়ে অনার্স পাস করে গেল।
এর মধ্যে নাদিয়া ট্রান্সফার নিয়ে জগন্নাথ কলেজে চলে গেল। তার বাবা বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি করতেন। তিনি ঢাকায় বদলি হয়েছেন।
রেজাল্টের পর তিন মাসের বিরতি। তিন মাস পর রেজাল্ট বের হবে, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ শুরু করব। আমি আমার গ্রামের একটা স্কুলে পার্টটাইম শিক্ষকতা শুরু করলাম। এর মধ্যে কতবার যে ভেবেছি, এমএ পড়তে পড়তে মাধবী আর আমার মধ্যকার ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হবে। আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব।
রেজাল্টের পর এমএ পড়তে গিয়েই বিহ্বল হয়ে পড়লাম আমি। দেখি, মাধবীর হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুর!
কোনো রকমে এমএ পাস করে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি।
তারপর চড়াই-উতরাইয়ের জীবন আমার। চাকরি, বিয়ে, সন্তান—এসব।
কোথায় হারিয়ে গেল মাধবীলতা! আমার কাছ থেকে অনেক দিন আগেই মাধবী নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আমি মাধবীকে শেষ পর্যন্ত আমার কাছ থেকে সরিয়ে দিতে পারিনি।লতার মতো এই দীর্ঘ সময় ধরে সে আমার হূদয়কে জড়িয়ে থেকেছে। অনেক চেষ্টা করেছি মাধবীলতার মূলোৎপাটন করতে। কিন্তু আমার হূদয় হার মানেনি। আমি এখনো আমার স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছি। হূদয় থেকে বারবার মাধবীকে টেনে নামিয়ে ওখানে স্ত্রীকে স্থান দিতে চেয়েছি; কিন্তু হূদয় আমার কথা শোনেনি। ভবিষ্যতেও শুনবে কি না, জানি না।