আমার ক্যারিয়ারটা পরিতৃপ্তির স্বাদই দিয়েছে- ব্রায়ান লারা

0
830
Print Friendly, PDF & Email

স্পোর্টস ডেস্ক(৩ জানুয়ারী):পল শুভ্র: এত বছর ক্রিকেট খেলার পর, যে ক্রিকেট একরকম জীবনই হয়ে গিয়েছিল আপনার, সেটি ছেড়ে দেওয়ার পর কখনো শূন্যতার একটা অনুভূতি হয়নি?
ব্রায়ান লারা: নট রিয়েলিআমি মনে করি, আমার ক্যারিয়ারটা পরিতৃপ্তির স্বাদই দিয়েছে আমাকে১৭ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে খেলেছিএরও আগে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর হয়ে খেলেছি; খেলেছি স্কুল ক্রিকেট, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেকম তো আর খেললাম নাঅবসর নেওয়ার সময়ে আমার মনে হয়েছিল, সেটিই উপযুক্ত সময়সিদ্ধান্তটা নেওয়ার অনেক কারণই ছিলছয় বছর পরে এসেও মনে করি, ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছিজীবন এগিয়ে যাচ্ছেএই ছয় বছরে অনেক কিছুই করেছিএই যেমন আবার বাংলাদেশে এলাম চিটাগং কিংসের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েআমি খুব সুখীক্রিকেট যে একেবারে খেলি না, তা নয়মাঝে মাঝে চ্যারিটি ম্যাচ খেলার জন্য আবার প্যাড-ট্যাড পরিসব মিলিয়ে আমি খুব ভালো আছি
উ. শু.: ২০০৭ বিশ্বকাপে বারবাডোজে যে সংবাদ সম্মেলনে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটিতে আমি উপস্থিত ছিলামআপনার ঘোষণাটা এমন আকস্মিক ছিল যে, সাংবাদিকেরা সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিলআগেই ভেবে-টেবে ওই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন, নাকি তা ছিল তাক্ষণিক?
লারা: ওই বিশ্বকাপটা আমাদের পরিকল্পনামতো হয়নিতবে সত্যি বলছি, ওই সময় আমার মনে হয়েছিল, দলটার নতুন একজন নেতা দরকার এবং তাঁর মাথার ওপর সাবেক অধিনায়ক বা বেশি সিনিয়র খেলোয়াড় না থাকাই ভালোআমি মনে করি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভালোর জন্য ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটাই আমি নিয়েছিলাম
উ. শু.: গত বছর কলম্বোতে আইসিসি হল অব ফেমে অন্তভুর্ক্তির পর বক্তৃতা দেওয়ার সময় আপনার প্রয়াত বাবা প্রসঙ্গে খুব আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেনআপনার জীবনে কি বাবার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি?
লারা: অবশ্যইক্রিকেটার হিসেবে, মানুষ হিসেবে আমাকে আর কেউ এত প্রভাবিত করেনিআমি ছিলাম বাবার শেষ সন্তানআমাদের পরিবার ছিল অনেক বড়১১ জন ভাইবোনসবার ছোট হলে যা হয়, আমার সঙ্গে উনি প্রচুর সময় কাটাতেনঅন্য ভাইবোনেরা হয়তো এ জন্য আমাকে ঈর্ষাও করতআমাদের সম্পর্কটাও ছিল দারুণক্রিকেটের ব্যাপারে সব সময়ই তাঁর সমর্থন পেয়েছিহি ওয়াজ আ গ্রেট ম্যানআমি জীবনে যা করেছি, এতে তাঁর অনেক বড় অবদান আছেআমার বোন অ্যাগনিসেরও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাআমার এত উপরে উঠে আসায় আমার পরিবার, প্রয়াত জোয়ি ক্যারু (ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যান), স্যার গারফিল্ড সোবার্স…এমন আরও অনেকের অবদান আছেতবে বাবা তো বাবাইতাঁর কোনো তুলনা হয় না
উ. শু.: আপনার ব্যাটিংয়ের মধ্যে একটা মাদকতা ছিলতা বোঝাতে মায়াবী বলব না জাদুকরি, বুঝতে পারছি নাআপনার ব্যাটিং অন্যরা বিশ্লেষণ করেছে, আমরা অনেকে অনেক লেখা লিখেছিকিন্তু আপনাকেই যদি কোনো নির্দিষ্ট কিছুর কথা বলতে বলি, যা ব্রায়ান লারাকে সবার চেয়ে আলাদা করে দিয়েছিল?
লারা: আলাদা কি না জানি নাএটা বলতে পারি, আমি রান করতে ভালোবাসতামসব সময়ই আমি রান করার সুযোগ খুঁজতামমনমানসিকতায় ও খেলায় আমি ছিলাম খুব আক্রমণাত্মকরান ছিল আমার আত্মবিশ্বাসের জ্বালানিআরেকটা ব্যাপার ছিল, কোনো মাইলফলক ছুঁলে আমি সেটিকেই যথেষ্ট মনে করতাম নাব্যাটিং করতে আমি খুব ভালোবাসতামসেই স্কুল ক্রিকেটে খেলার সময় থেকেই আমি ছিলাম দলের মূল ব্যাটসম্যানওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ঢোকার পর তা হতে তিন-চার বছর লেগেছেডেসমন্ড হেইন্স, রিচি রিচার্ডসনরা অবসর নেওয়ার পর সেই দায়িত্বটা আমার ওপর পড়লআমি এই চাপটা খুব উপভোগ করতামচাপ যেহেতু বললাম, আমি সেটি ভালোভাবেই সামলেছি
উ. শু.: ১৯৯৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তখনকার প্রধান নির্বাচক ডেভিড হলফোর্ড আমাকে বলেছিলেন, আপনার মতো বল গ্যাপে মারতে তিনি আর কাউকে দেখেননিআগের প্রশ্নটা মাথায় এল এ কারণেই…
লারা: হ্যাঁ, এটা আমি খুব ভালো পারতামখুব কম বয়স থেকেই আমি যখন ব্যাট করতাম, আশপাশে হয়তো ফুলের টব থাকত, গাছ থাকতআমি ওসবের মধ্য দিয়ে মারতে পারতামআমি জানি না, সেটিই পরে কাজে লেগেছে কি নাতবে এটা বলতে পারি, আমি সব সময়ই দ্রুত রান করতে পছন্দ করতামবোলিং দলকে চাপে ফেলতে চাইতামএটাই ছিল আমার শক্তির দিকঠুকঠুক করে রান করাটা আমার কখনোই পছন্দ ছিল নাআমি চাপটা বোলারদের ওপর ফিরিয়ে দিতে চাইতামআসলে এক কথায় বলতে গেলে, ব্যাটিং জিনিসটাই আমার খুব প্রিয় ছিল
উ. শু.: ফিল্ড প্লেসিং দেখার পর সেটি কি আপনার মনে আঁকা হয়ে যেত?
লারা: কিছুটা তো বটেইকোন ফিল্ডার কোথায় আছে, কোথায় মারলে রান হবে না, পাঁচ বা দশ গজ ডানে বা বাঁয়ে মারলে রান পাওয়া যাবেএমন একটা ছবি তো মনে আঁকা থাকতইমাথার সামনে শুধু দুটি চোখ নিয়ে তো আর পুরো মাঠটা দেখা যায় নাতবে মাঠে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, এমন একটা ছবি তো স্মৃতিতে থাকতই
উ. শু.: শুধু স্যার গ্যারি সোবার্সের রেকর্ড ভেঙেছেন বলেই নয়; দুজনই বাঁহাতি, দুজনেরই উঁচু ব্যাক লিফট, দুজনই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানসব মিলিয়ে অনেকেই আপনাদের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পানআপনি কি কখনো স্যার গ্যারিকে ব্যাটিং করতে দেখেছেন?
লারা: না, স্যার গ্যারির সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন আমার বয়স ১৪বারবাডোজে স্যার গারফিল্ড সোবার্স টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়েস্যার গ্যারি প্রথম দেখেই আমার ব্যাটিং খুব পছন্দ করে ফেললেনএর পর থেকেই উনি সুযোগ পেলেই আমার কথা উল্লেখ করতেনএটা আমার জন্য খুব অনুপ্রেরণাদায়ী ছিলতবে আমার সত্যিকার ব্যাটিং রোল মডেলের কথা যদি বলি, সেটি ছিলেন রয় ফ্রেডরিকসসত্তরের দশকে উনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে ওপেন করতেনআমিও তখন ওপেন করিফ্রেডরিকসকে দেখে আমিও ব্যাটিংয়ের সময় কবজির কাছে বোতাম লাগানো লম্বা হাতা জামা পরতামআমি যদি কারও ব্যাটিং অনুকরণ করার চেষ্টা করে থাকি, সেটি হলেন রয় ফ্রেডরিকস
উ. শু.: ১৯৯৫ সালে শারজায় আমার নেওয়া আপনার প্রথম সাক্ষাকারেও আপনি এ কথা বলেছিলেনতবে একই সঙ্গে বলেছিলেন, গর্ডন গ্রিনিজের টেকনিক, ডেসমন্ড হেইন্সের টেম্পারামেন্ট ও ধৈর্য, ভিভ রিচার্ডসের দাপট আপনার কেমন মন কেড়েছিলআপনি কি মনে করেন, নিজের ব্যাটিংয়ে এই সবকিছুর সম্মিলন করতে পেরেছিলেন?
লারা: ওই কথাটা কেন বলেছিলাম, সেটি আগে ব্যাখ্যা করিআমার প্রথম হিরো ছিলেন রয় ফ্রেডরিকসতাঁকে ব্যাটিং করতে দেখার পর যেটা হলো, আমিও তাঁর মতো বাঁহাতি, নিজেও ওপেনিং ব্যাটসম্যান, তাই…তবে বয়স একটু বাড়ার পর যা হয়, আপনি একেক ব্যাটসম্যানের একেক ধরনটা বুঝতে শিখবেনগর্ডন গ্রিনিজকে ওপেনিং করতে দেখা মানে ছিল দারুণ অভিজ্ঞতাশিয়ার ক্লাস, সঙ্গে দুর্দান্ত টেকনিকডেসমন্ড হেইন্স ছিলেন সত্যিকার এক ফাইটারদেখতে হয়তো গর্ডন গ্রিনিজের মতো রোমাঞ্চক ছিলেন না, তবে রান কিন্তু কম করেননিউনি সারা দিন ব্যাট করতেন, কখনোই এমন মনে হতো না যে, সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণে আছেঅথচ দিন শেষে দেখা যেত, উনি তখনো আছেনআর ভিভ রিচার্ডস তাঁর দিনে ছিলেন রীতিমতো বিধ্বংসীএই যে একেক জনের একেকটা শক্তির জায়গা, সেগুলোকে একখানে করতে কে না চাইবে! আমার মনে হয়, টেলিভিশনে ওদের খেলা দেখে, পোর্ট অব স্পেনে গিয়ে খেলা দেখে, পরে খুব তরুণ বয়সে দলের অংশ হয়ে…আমি যা হয়েছি, সেটি তাঁরাই তৈরি করে দিয়েছেনআমি সবার কাছ থেকেই কিছু না কিছু নিয়েছি
উ. শু.: ভিভ রিচার্ডস কি আপনার দেখা সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান?
লারা: অবশ্যই উনি আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যানটেন্ডুলকারকেও আমি ওখানেই রাখবএই দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়া কঠিনকথাটা বলে ফেললামতবে আমি মনে করি, ভিন্ন যুগের ব্যাটসম্যানদের তুলনা করাটাই ঠিক নয়, বরং প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অসাধারণত্ব উপভোগ করা উচিতএই দুজনই অসাধারণআমি যে এই দুজনকেই ব্যাট করতে দেখেছি, এটাকে বড় পাওয়া বলে মানি
উ. শু.: টেন্ডুলকারের কথা তুলে ভালোই করলেনএরপর এই প্রসঙ্গেই আসতামএখন যেমন ফুটবল বিশ্বে মেসি-রোনালদো, নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেটে তেমনই বড় তর্ক ছিলটেন্ডুলকার, না লারা? ৩৭৫ ও ৫০১ করে আপনি এগিয়েও গিয়েছিলেন, কিন্তু কেন যেন মনে হয়, পরে আপনি নিজেই এই রণে ভঙ্গ দেনআসলেই কি তাই?
লারা: ১৯৯৫ সালের পরের বছর তিনেক সময়টা আমার জন্য ছিল খুব কঠিনবিশ্বরেকর্ড করে ফেলার পর তা নিয়ে যা হয়েছে, সেটি ছিল বড় একটা চাপএটা সামলাতে আমার একটু সময় লেগেছেআমার ক্রিকেটের তাতে ক্ষতিই হয়েছিলতবে ১৯৯৮-১৯৯৯ এর দিকে আমি আগের রূপে ফিরে আসিএর পর থেকে বয়স ধরে ফেলার আগ পর্যন্ত আমি অনেক সাফল্যই পেয়েছি
আমার ক্যারিয়ারটা আসলে তিনটা পর্যায়ে ভাগ করা যায়১৯৯৫-এর আগে, ১৯৯৫-এর পরে এবং ১৯৯৮ থেকে শেষ পর্যন্তউত্থান-পতন হয়তো ছিল, তবে আমি কোনো কিছুর সঙ্গেই আমার ক্যারিয়ারটা বিনিময় করতে রাজি নইআমি এটি উপভোগ করেছিসামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিঅনেক কিছু শিখেছিওশুধু ক্রিকেটার হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেওআমি পরিণত হয়েছিআমার ক্যারিয়ার নিয়ে আমি খুব গর্বিত

 

নিউজরুম

 

শেয়ার করুন