আইনজীবী প্রত্যাহার করে নিলেন সাকা চৌধুরী

0
776
Print Friendly, PDF & Email

ঢাকা (৩০জানুয়ারী) : মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-১ তার বিরুদ্ধে চলমান মামলার কার্যক্রম থেকে নিজের আইনজীবীদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল তার আবেদন গ্রহণ করে জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার আইন অনুসারে সাকা চৌধুরীর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রের খরচে একজন আইনজীবীকে নিয়োগ দেবেন।

এ অবস্থায় বুধবার ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দেওয়ার পর সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে ১৭তম সাক্ষীকে আসামিপক্ষের জেরা করা সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবার নিয়োগ পাওয়ার পর রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী এ সাক্ষীকে জেরাসহ আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন বলে ও জানিয়েছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

বুধবার সকালে শুরু হয় সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৭তম সাক্ষী একজন ক্ষতিগ্রস্ত নারী সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ। সাক্ষ্য শেষে দ্বিতীয়ার্ধ্বে তাকে জেরা করার কথা ছিল আসামিপক্ষের আইনজীবীদের। কিন্তু তার আগেই সকালে ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীর দু’টি আবেদন খারিজ করে দিলে তিনি তার আইনজীবীদের প্রত্যাহারের আবেদনটি করেন। আবেদন দু’টির মধ্যে একটিতে সংসদ সদস্য হিসেবে চলমান সংসদ অধিবেশনে যোগদান করতে চেয়ে ৭ দিনের জন্য জামিনের আবেদন জানিয়েছিলেন সাকা চৌধুরী। অপরটিতে সাকা চৌধুরী আবেদন জানান, সব সাক্ষ্যগ্রহণ ক্যামেরা ট্রায়ালে নয়, যেন প্রকাশ্যে করা হয়।

আবেদন দু’টি খারিজ হয়ে যাওয়ার পর সাকা চৌধুরী আসামির কাঠগড়ায় বসেই হাতে লিখে তার আইনজীবীদের প্রত্যাহারের আবেদন জানান। তিনি আবেদনে এবং ট্রাইব্যুনালকে মৌখিকভাবে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপতি সংসদ অধিবেশন ডেকেছেন। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে যোগদান এবং সরকারের বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করার অধিকার আমার রয়েছে।’’

একটি আইনকে উদ্ধৃত করে সাকা আরও বলেন, ‘‘ওই আইনে সংসদ অধিবেশন শুরুর দিন থেকে পরবর্তী ৭ দিন কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম না চলার কথা বলা হয়েছে। আমাকে সংসদ অধিবেশনে যোগদান করতে না দিয়ে ও জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে আমার অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে, ওই আইনেরও লঙ্ঘন করা হয়েছে। তাই আমার আইনজীবীদের প্রত্যাহার করে নিলাম।’’  

মধ্যাহ্ন বিরতির পরে দুপুরে সাকা চৌধুরীর কোনো আইনজীবীকে না দেখে ট্রাইব্যুনাল এ ব্যাপারে জানতে চান। এ সময় সাকা চৌধুরী তার আইনজীবীদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘এখন আর তাদের আসার প্রয়োজনীয়তা নেই।’’

ট্রাইব্যুনাল তার আদেশে বলেন, ‘‘মামলার কার্যক্রম তো থেমে থাকবে না। বিচারকাজ চলবে। আইন অনুসারে আসামির পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রের একজন আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হবে বৃহস্পতিবার। রাষ্ট্র নিযুক্ত ওই আইনজীবী সাক্ষীর জেরা করাসহ আসামির পক্ষে পরবর্তী বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।’’    

উল্লেখ্য, সাকা চৌধুরীর পক্ষে এতোদিন মামলা লড়ছিলেন ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট আহসানুল হক হেনা। মামলার শুরুর দিকে অবশ্য সাকা চৌধুরী কোনো আইনজীবী নিয়োগ দেননি। প্রথমে নিজেই তার মামলার শুনানি করে আসছিলেন সাকা চৌধুরী। কিছুদিন পরে রাষ্ট্রের খরচে একজন আইনজীবীকে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্র নিযুক্ত ওই আইনজীবী বেশ কিছুদিন মামলা পরিচালনার পর নিজের পক্ষে আইনজীবীদের নিয়োগ দেন সাকা চৌধুরী।

এর আগে বুধবার সকালে রুদ্ধদ্বার কক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয় সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৭তম সাক্ষী ক্ষতিগ্রস্ত নারীর। ট্রাইব্যুনালের আদেশে ক্যামেরা ট্রায়াল চলাকালে সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। শুধু অভিযুক্ত সাকা চৌধুরী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের ৩ জন করে মোট ৬ জন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন রুদ্ধদ্বার কক্ষে। আইনজীবীরা যেন সাক্ষী এবং সাক্ষ্যের বিষয়ে কোনো প্রকার তথ্য না দেন, সে শর্তও আরোপ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

দ্বিতীয়ার্ধ্বে সাক্ষীকে আসামিপক্ষের জেরা করা সম্ভব না হওয়ায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেরা মুলতবি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।  
 
উল্লেখ্য, গত বছরের ৩ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ওই নারী সাক্ষীকে ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দেওয়ার অনুমতি দেন ট্রাইব্যুনাল। ১২ ও ১৭ ডিসেম্বর এ সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও আসামিপক্ষ সময়ের আবেদন জানান। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস প্রবাসী ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে একের পর এক আবেদন জানাতে থাকেন সাকা চৌধুরী ও তার আইনজীবীরা। এসব আবেদনের শুনানি করতে গিয়ে ঝুলে যায় তার বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রম। প্রতিটি আদেশই খারিজ ও নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। বুধবার সর্বশেষ দু’টি আবেদন খারিজ করে দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর দিন ধার্য করায় প্রায় দুই মাস মুলতবি হয়ে থাকা বিচারিক কার্যক্রম ফের শুরু হলো।

সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত বছরের ১৪ মে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর এ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আরও ১৬ জন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন, বাংলা একাডেমীর সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সলিমুল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সিরু বাঙালি, শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ভাতিজা গৌরাঙ্গ সিংহ ও পুত্র প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ, শহীদ পরিবারের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট নির্মল চন্দ্র শর্মা, আব্বাস উদ্দিন আহম্মেদ (আব্বাস চেয়ারম্যান), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উপাচার্য মোঃ সালেহ উদ্দিন, ব্যবসায়ী পরাগ ধর, চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক ছাত্রনেতা কাজী নূরুল আফসার, মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপ কমান্ডার সৈয়দ মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিলের জগৎমল্লপাড়ার গণহত্যায় শহীদ পরিবারের দুই সদস্য অরুণাংশু বিমল চৌধুরী ও তার ভাতিজা আশীষ চৌধুরী, অধ্যক্ষ গোপাল চন্দ্র দাশ, নিজাম উদ্দীন আহমেদ ও ফয়েজ আহমেদ সিদ্দিকী।

তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন আসামিপক্ষ।

২০১০ সালের ২৬ জুন হরতালের আগের রাতে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায়ই সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রত্যুষে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ১৯ ডিসেম্বর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। পরে ৩০ ডিসেম্বর আদালতের নির্দেশে প্রথমবারের মতো সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অগ্রগতি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত দল। একই বছরের ১৪ নভেম্বর সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ১৮ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

৫৫ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগের সঙ্গে এক হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক নথিপত্র এবং ১৮টি সিডি ট্রাইব্যুনালে জমা দেয় প্রসিকিউশন।

৪ এপ্রিল সাকার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে তার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩টি মানবতাবিরোধী অপরাধের উল্লেখ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ করে গুডস হিলে নির্যাতন, দেশান্তরে বাধ্য করা, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধ। ৩ মে ও ৭ মে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাকা চৌধুরীর বিচার।

নিউজরুম

শেয়ার করুন