৩০ জানুয়ারি, ২০১৩: কবিতা একটি সুকুমার শিল্প। আধুনিক কবিতা বোঝা এবং লেখার জন্য প্রয়োজন গভীর অভিনিবেশ। হইচই করে আর যাই হোক ভালো কবিতা হয় না। তারপরও কবিতাকে কেন্দ্র করে হইচই আনন্দ উৎসবের কমতি নেই। কবিরা যেমন কবিতা লিখে প্রভূত আনন্দ পান তেমনি কবিতা পাঠ করে শোনাতেও তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনাও অনেক। কবির স্বকণ্ঠে আবৃত্তি পাঠক-শ্রোতাদের জন্য যেন সোনায় সোহাগা। কাব্যরসিকদের জন্য তা একটি বাড়তি পাওনা বৈকি।
ব্যস্ততায় ঠাসা রাজধানী ঢাকা শহরের প্রত্যেক নাগরিকের জীবন। রাস্তায় নিয়মিত ট্রাফিক জ্যামেও অতিষ্ঠ সবাই।মানুষ আজ অনেক বেশি যান্ত্রিক। জীবন-জীবিকার তাগিদে সারাক্ষণ সবাইকে দৌড়াতে হয়। এ জীবনে একটু ফুরসত খুঁজে পাওয়া বড়ই মুশকিল। সে জন্য আনন্দ উচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রগুলো সীমিত হয়ে আসছে। কবিতা পাঠ ও শোনার জন্য সময় বের করা আরো কঠিন।
তারপরও এই কঠিন নাগরিক জীবনে একটু শান্তির পরশ বোলাতে মাঝে মাঝে আয়োজন হয় আনন্দ উৎসবের। সম্প্রতি এ রকমই একটি প্রাণবন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয় শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জাতীয় প্রেস কাবে।
দিনটি ছিল শনিবার। জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখ। জাতীয় প্রেস কাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত হলো এক ব্যতিক্রমধর্মী কাব্যোৎসব। জাতীয় প্রেস কাব সদস্য কবিদের সংগঠন কবিতাপত্র পরিষদের দশ বছরপূর্তি উপলক্ষে এই কাব্য উৎসবের আয়োজন করা হয়।
কবিতাপত্র পরিষদ গত দশ বছর ধরে জাতীয় প্রেস কাবে নিয়মিত স্বরচিত কবিতাপাঠের আসর করে আসছে। প্রতি মাসের শেষ দিন প্রেস কাবের তিন তলায় এই আসর বসে। পঠিত কবিতা নিয়ে প্রতি মাসে একটি কবিতা সঙ্কলনও বের হয়।
দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কবিসহ সারা দেশ থেকে আসা এক ঝাঁক তরুণ কবি এবং প্রেস কাবের সদস্য কবিদের অংশগ্রহণে উৎসবে আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। রসাত্মক আলোচনা, আড্ডা আর স্বরচিত কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী উৎসব ছিল দারুণ উপভোগ্য। বিপুলসংখ্যক কবির উষ্ণ হৃদয়ের সরব উপস্থিতিতে বাইরের বয়ে যাওয়া শৈত্যপ্রবাহ ভেতরে প্রবেশের তেমন সুযোগ পায়নি। অনুষ্ঠানে আধুনিক কবিতার গতিপ্রকৃতি নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়।
শীতের বিকেলে আয়োজিত উৎসবে শীতের পিঠা পাটিসাপটা দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করা হয়। এ ছাড়া উৎসব অঙ্গনে ছিল সার্বক্ষণিক গরম কফির সরবরাহ। দশ বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে কবিতাপত্রের দ্বিভাষিক একটি সঙ্কলন বর্ধিত কলেবরে প্রকাশিত হয়। সঙ্কলনে প্রায় ৫০ জন কবির কবিতা ইংরেজি অনুবাদসহ স্থান পায়।
কবিতাপত্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক কবি এরশাদ মজুমদারের স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।জাতীয় প্রেস কাবের সভাপতি কামাল উদ্দীন সবুজ, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ উপস্থিত কবিদের প্রেস কাবের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানান। সত্তর দশকের আর এক বিশিষ্ট কবি হাসান হাফিজও উৎসবের সাফল্য কামনা করে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন।
আলোচনার শুরুতে বিশিষ্ট আলেম মাওলানা আব্দুস সালাম ইসলামের দৃষ্টিতে কবি ও কবিতার তাৎপর্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পবিত্র কুরআনে কবি ও কবিতার প্রসঙ্গ বেশ কয়েকবার এসেছে। ইসলাম যেমন বিপথগামী কবিদের নিন্দা করেছে তেমনি ঈমানদার ভালো কবিদের প্রশংসাও করেছে।
বর্তমান সময়ে দেশের প্রধান কবি আল মাহমুদ ছিলেন উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। এ ছাড়াও কবিতা উৎসবে যোগ দেন পঞ্চাশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, কবি বেলাল চৌধুরী, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, ষাটের দশকের কবি অসীম সাহা, বরিউল হুসাইন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত গীতিকার কবি এবং কবিতাপত্রের সম্পাদক কে জি মোস্তফা।
আল মাহমুদ বলেন, কবির কাজ হলো জাতিকে স্বপ্ন দেখানো। স্বপ্নের মাধ্যমে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দেয়া।স্বপ্ন দেখা একান্ত প্রয়োজন কারণ স্বপ্ন ছাড়া মানুষের জীবন সার্থক হয় না। আল মাহমুদ বলেন, কবিতাকে আমরা ঠিক যত সহজ মনে করি, তত সহজ নয়। কবিতা হচ্ছে একটি জটিল শিল্প। এই জটিলতার মধ্যে রয়েছে অনন্য আনন্দ-উচ্ছ্বাস।তিনি বলেন, কবিতা নির্মাণের জন্য প্রয়োজন মানুষের ভালোবাসা। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষের ভালোবাসার মধ্যে বাঁচতে হবে। তিনি বলেন, আমি কবিতা নিয়ে সারা জীবন চিন্তা করেছি। কবিতার মূলে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। কবিতাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর শুরু হয় কবিদের কণ্ঠে কবিতা পাঠের আসর। সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজের সভাপতিত্বে কবিতা পাঠ চলে প্রায় রাত ৮টা পর্যন্ত।
সভাপতির বক্তব্যে জাহাঙ্গীর ফিরোজ কবিতায় প্রেমের উপস্থিতির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে প্রেম ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই। পৃথিবী মূলত প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। স্রষ্টা ভালোবেসেছিলেন বলেই এ জগতের সৃষ্টি হয়েছে।
কবিরা প্রেম, প্রকৃতি, পরিবেশ, দেশ সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে রচিত তাদের পঙ্তি মালা আবৃত্তি করেন। কেউ কেউ অনেক দীর্ঘ কবিতা সাবলীলভাবে মুখস্থ আবৃতি করেন।
কবিতা পাঠে অংশ নেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি অসীম সাহা, কবি কে জি মোস্তফা, কবি রবিউল হুসাইন, কবি মাশুক চৌধুরী, কবি মোস্তফা মজিদ, কবি শাহীন রেজা, কবি জাকির আবু জাফর, কামরুজ্জামান, শাহীন রিজভী, ফরিদুজ্জামান, ফেরদৌসী মাহমুদ, মাহমুদ হাফিজ, ফেরদৌস সালাম, দিলদার হেসেন, তারিফ রহমান, রোকেয়া ইউসুফ, রফিক হাসান, জামসেদ ওয়াজেদ, ওসমান গণি, সাবিত সারওয়ার, আবু হানিফা, রুনু আঞ্জুমান, শাহানা জেসমীন, খোরশেদ বাহার, রুহুল গনি জ্যোতি, শামসুল হুদা চৌধুরী, সুরমা ও মাসুমা বেগম।
উৎসবের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল মোবাইল কোম্পানি সিটি সেল ও ভূমি উন্ন্য়ন কোম্পানি ট্রপিক্যাল হোমস।মিডিয়া সহযোগী হিসেবে ছিল দৈনিক নয়া দিগন্ত ও চ্যানেল আই।