কৃষি ডেস্ক(২৯ জানুয়ারী): শুষ্ক মওসুমে ব্রহ্মপুত্রে নাব্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। পানি না থাকায় এ নদের মূল প্রবাহ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নদীর বুকে রাশি রাশি বালুচর জেগে ওঠায় মূল স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে সরু খালে পরিণত হয়েছে। দেখে বিশ্বাসই করা যায় না ভরা বর্ষায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করা ব্রহ্মপুত্র শুষ্ক মওসুমে তার যৌবন হারিয়ে এমন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। নাব্যতা হারিয়ে নৌযান চলাচল প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
তিব্বতের হিমালয় পর্বতের কৈলাশ শৃঙ্গের মানস সরোবর হ্রদে উৎপন্ন বিশ্বের ২২তম দীর্ঘ ব্রহ্মপুত্র নদ ভুটান, চীন ও ভারতের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, সীমান্তের ওপারে ভারত এ নদীর ওপর বেশ ক’টি পয়েন্টে বাঁধ দিয়ে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করেছে। সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণে তারা বাঁধ, রিজার্ভার, ড্যামসহ অসংখ্য অবকাঠামো নির্মাণ করে পানি ধরে রেখে শুষ্ক মওসুমে ফিডার ক্যানেলের মাধ্যমে তা ব্যবহার করছে। এ জন্য তারা কয়েক হাজার কিলোমিটার খাল খনন করেছে। ব্রহ্মপুত্র নদে পানি সঙ্কট ও নাব্যতা হ্রাস এর অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা।
এ দিকে নদীতে পানি না থাকায় রাজীবপুর ও রৌমারীর সাথে চিলমারী ও গাইবান্ধা রুটের নৌযান চলাচল প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নদীতে ২০টি স্থানে নৌকা আটকে যায় বলে নৌযান কর্মীরা জানান।অনেক জায়গায় নদীর মধ্যে যাত্রী নামিয়ে নৌকা ঠেলে নামাতে হয়। ফলে নদী পারাপারে দ্বিগুণ সময় লাগছে। যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় পরিবেশ বিপর্যয়সহ কৃষি আবাদে নেমে এসেছে স্থবিরতা। নদীর তলদেশে পানি না থাকায় সেচনির্ভর কৃষকেরা পড়েছেন সঙ্কটে। ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড়ের মানুষের দাবিÑ অতিদ্রুত ড্রেজিং করে নদের পানিপ্রবাহ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হোক। সরেজমিন ব্রহ্মপুত্র নদ এলাকায় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিগত ৫০ বছরেও কোনো ড্রেজিং না করায় নদের তলদেশে পলি জমে এর নাব্যতা হ্রাস পেয়ে এককালের উত্তাল নদ ছন্দ হারিয়ে বর্তমানে মরা গাঙ্গে পরিণত হয়েছে। বিলুপ্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্যসহ মৎস্যসম্পদ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণী। হাজার হাজার জেলে পরিবার এ পেশা ছেড়ে বেকারত্ব ঘোচাতে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। খেয়া পারের মাঝিরা বাপ-দাদার পেশা বৈঠা ছেড়ে কলের নৌকা চালিয়েও শেষ রা করতে পারেননি। ছাড়তে হয়েছে এ পেশা; কারণ নদে নৌকা চালানোর মতো পানি নেই।
এ দিকে নদের তলদেশ ভরাট থাকায় বর্ষা মওসুমে একটু পানিতেই বন্যা দেখা দেয়। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা শাখা নদী এখন বিত্তবানদের ফসলি জমি।
চিলমারী নৌবন্দর থেকে রাজীবপুর ও রৌমারী হয়ে জামালপুর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদ এখন প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে।পানিপ্রবাহ না থাকায় নদের তলদেশে চলছে চাষাবাদ। ফলে এক দিকে সরকার হারাচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব অন্য দিকে হুমকির মুখে রয়েছে বিভিন্ন এলাকা ও বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট ও রাজীবপুর উপজেলা পরিষদ ভবন। শুষ্ক মওসুমে নদে পানি কমে গেলে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল দখল নিতে প্রতি মওসুমেই মারামারিতে প্রাণহানি ঘটনার মতো ঘটনাও ঘটে। বর্ষা মওসুমে একটু পানিতেই দেখা দেয় প্রবল বন্যা। শুরু হয় নদীভাঙন। এ দিকে নদীভাঙন রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় বর্ষা মওসুমে নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম, বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, স্কুল, মাদরাসা। এ এলাকার মানুষের অভিযোগ, নদীভাঙন প্রতিরোধে প্রতি বছর মানববন্ধন, মিছিল-স্লোগান করেও কোনো লাভ হয়নি।সরকারিভাবে কোনো স্থায়ী পদপে নেয়া হয়নি। বর্তমানে পানির অভাবে রাজীবপুর ও রৌমারীঘাটে নৌকা না পৌঁছায় নদীপথে ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
রাজীবপুর উপজেলা শহর থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে এ নদের অবস্থান। চলতি মওসুমে সরকারিভাবে ড্রেজার দিয়ে নদীর পলিমাটি অপসারণ না করলে সামনে যেমন এ উপজেলার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে, তেমনি চিলমারীর ভাসমান তেল ডিপো থেকে উত্তরাঞ্চলের ১২টি জেলার জ্বালানি তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এ তেলের ডিপো থেকে রাজীবপুর, রৌমারী, দেওয়ানগঞ্জ ও ফুলছড়ি উপজেলার লাখ লাখ কৃষক ডিজেল ক্রয় করে তাদের বোরোর আবাদ করেন। নদীতে পানি না থাকায় তেলের জাহাজ চিলমারী বন্দরে আসতে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। সে কারণে রাজীবপুর, রৌমারী, দেওয়ানগঞ্জ ও ফুলছড়ি উপজেলাবাসীর শুধু সমস্যাই নয়, পুরো উত্তরাঞ্চলের ১২টি জেলার মানুষের সমস্যায় পড়তে হয়।
রাজীবপুর নৌকাঘাটের দায়িত্বে থাকা ইজারাদার জাহের মণ্ডল জানান, বর্ষা মওসুমে নদী পারাপারে যেখানে নৌকায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে শীত মওসুমে নদীতে পানি না থাকায় প্রায় চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। তার পরও নৌকা রাজীবপুর ঘাট থেকে অনেক দূরে রাখতে হচ্ছে, ঘাটে আনা সম্ভব হচ্ছে না। মাঝপথে যাত্রীদের বালুচরে নামিয়ে খালি নৌকা কোনো মতো টেনে ঘাটে আনতে হয়।যাত্রীরা দুই কিলোমিটার বালুচর হেঁটে ও মালামাল নিয়ে পড়েন চরম বিপাকে।
এ ব্যাপারে রাজীবপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আকবর হোসেন হিরো বলেন, অনেক চেষ্টা-তদবির করছি, কিন্তু নদী ড্রেজিং বা ভাঙনরোধে কোনো ভালো খবর পাচ্ছি না।
নিউজরুম