২৯ জানুয়ারি, ২০১৩: চিত্রকলায় ছাপচিত্র একটি আধুনিক মাধ্যম। বিশেষত আধুনিক কালে ছবিকে সাধারণের হাতের নাগালে এনে দিতে এই মাধ্যম বেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখে। অবিভক্ত বাংলায় ছাপাই ছবি নানাভাবে সমগ্র বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। যুগের প্রয়োজনে মুদ্রণশিল্পকে সমৃদ্ধ করতে যে মাধ্যমের উদ্ভব, তা আজ হয়ে উঠেছে চিত্রশিল্পের এক অনন্য মাধ্যম।
দেশভাগ-পরবর্তীকালে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পচর্চার উদ্ভব ও চারুশিল্প প্রতিষ্ঠানের সূচনালগ্ন থেকেই ছাপাই ছবির প্রচলন ছিল, যদিও পূর্ণাঙ্গ ছাপচিত্র বিভাগ বা ছাপচিত্র স্টুডিও হয়েছে আরও পরে।
কথাগুলো হচ্ছে গ্যালারি কায়ায় চলমান ছাপাই ছবি-২ শীর্ষক প্রদর্শনীকে ঘিরে। গ্যালারিটি ২০১২-এর শেষদিকে আয়োজন করে ছাপাই ছবি-১ শীর্ষক একটি প্রদর্শনী, যেখানে তারা উপস্থাপন করেছিল কলকাতার সমকালীন ছাপাই চিত্রের প্রতিনিধিত্বশীল ছয় শিল্পীকে এবং এরই ধারাবাহিকতায় তারা আয়োজন করল ছাপাই ছবি-২-এর প্রথম পর্ব।
একটু ভিন্ন মাত্রার ও উপস্থাপনার তাদের এই আয়োজন, যাতে মোটামুটিভাবে বাংলাদেশের আধুনিক কালের ছাপাই ছবির হালহকিকত তুলে ধরা হয়েছে। এ দেশে ব্যবহূত মাধ্যমগত বৈচিত্র্য, দৃশ্যভাষা বা স্টাইলের বিভিন্নতা ও নানা প্রজন্মের অভিব্যক্তির সমন্বয়ে আঁকা একটি কোলাজ ক্যানভাস যেন এই প্রদর্শনী।
চোখ রাখি প্রদর্শনীর ছবিগুলোর দিকে। এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু, মাহমুদুল হক, আবুল বারক আলভী, রতন মজুমদার, রোকেয়া সুলতানা, ওয়াকিলুর রহমান, রফি হক, রশিদ আমিন, আনিসুজ্জামান, নগরবাসী বর্মণ ও শেখ মোহাম্মদ রোকনুজ্জামানের ছাপাইকর্ম।
বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলায় মোহাম্মদ কিবরিয়া এক অবিস্মরণীয় নাম। এ দেশে বিশুদ্ধ বিমূর্ত চিত্রধারার তিনিই পুরোধা। তাঁর চিত্রচর্চার কৃতকৌশল সব সময়ই চিত্রশিল্পের সব ছাত্রের বিশেষ মনোযোগের বিষয় আর ছাপাইকর্মের প্রসঙ্গে এই বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্ব বহন করে। কিবরিয়া বলতে যে আধুনিক নাগরিকের ব্যক্তিগত নির্জনতা ও একাকিত্ব থেকে উৎসারিত আধ্যাত্মিকতাকে আমরা জানি, তার কোনো ব্যতিক্রম এবারের প্রদর্শনীর কাজে নেই (যদিও তিনি এর বাইরে বেশ কিছু কাজ করেছেন)। বরং প্রবলভাবে কিবরিয়া বলতে যে কাজগুলোকে আমরা জানি, তা উপস্থাপিত হয়েছে। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০—এই সময়কে আমরা তাঁর কাজের চরম উৎকর্ষের সময় হিসেবে দেখি, এই প্রদর্শনীর কাজগুলো ওই সময়েরই। এই প্রদর্শনীতে তাঁর যে তিনটি কাজ আছে তারা শিরোনামহীন ১, ২ এবং মেমোরিয়াল ৫।
এবার আসি বাংলার শিল্পকলার অপর বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পী মুর্তজা বশীর প্রসঙ্গে। এ দেশের ছাপাই ছবির ইতিহাস ও জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর একটি কাজ জড়িয়ে আছে। কাজটি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়ে করা একটি লিনোকাট। শিরোনাম ব্লাডি টোয়েন্টিফার্স্ট বা রক্তাক্ত একুশ।মাত্র ২১ সে.মি.x১৭.৫ সে.মি. মাপের এই কাজটির সামনে দাঁড়ালে যেন শিরদাঁড়া দিয়ে একটি ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। মনে হয়, রফিক-জব্বারসহ সেই সময়ের বীরদের সঙ্গে মিছিলে আমিও যেন মুষ্টিবদ্ধ উদ্ধত হাতে প্ল্যাকার্ডসহ স্লোগানমুখর—রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই…। এরপর বাড়িওয়ালা শীর্ষক কাজটি যেন আরেক সময় পরিভ্রমণ অভিজ্ঞতার স্বাদ দেয়। স্থবির সময়ে এক বাড়িওয়ালা যেন অনন্তকাল বসে আছেন। এ ছাড়া আছে ইমেজ-১৮, ২৫ এবং গার্ল উইথ বার্ড শীর্ষক রচনাগুলো। তিনি বরাবরই মনোযোগ কেড়েছেন নিষ্ঠাবান শিল্পের দর্শক ও সমঝদারদের। আর এই আকর্ষণের প্রধান কারণ তাঁর রচনায় বুদ্ধির প্রয়োগ, রচনাশৈলী ও ভাষা নিয়ে নিরন্তর নিরীক্ষা।
কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের শিল্পচর্চার ইতিহাসে প্রবাদপ্রতিম এক নাম। বইয়ের মলাট, পত্রিকার অলংকরণ, কোনো প্রতিষ্ঠানের লোগো থেকে চিত্রকলা—সর্বত্রই তাঁর স্বাক্ষর উজ্জ্বল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে।
এমনকি সামান্য একটি প্রতিষ্ঠানের লোগোও যখন তিনি আঁকেন, তা-ও তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর বহন করে। ছাপাই দুনিয়ায় যাঁর এই বিশাল প্রতাপ, তিনি কিন্তু নিয়মিত ছাপাইশিল্পী নন। ছাপচিত্র বিভাগের সূচনালগ্নে শিল্পী শফিউদ্দিনের কাছে যাঁরা আগ্রহ নিয়ে ছাপাই মাধ্যমের পাঠ নিয়েছিলেন এবং কৃতীর স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তাঁর নাম বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তথাপি কিছু কাঠখোদাই ছাড়া তাঁর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ছাপাই ছবি আমার চোখে পড়েনি। এবারের প্রদর্শনীতে আমরা তাঁর কিছু কোরিওগ্রাফি মাধ্যমের কাজ দেখতে পাই। প্রদর্শনীতে তাঁর কাজের সংখ্যা চারটি। উজ্জ্বল বর্ণে আঁকা এই কাজগুলো তাঁর স্বাক্ষরকে উজ্জ্বলতার সঙ্গেই বহন করছে। এতে তাঁর নিজস্ব ভাষারীতি ও বাগ্ধারা স্বাভাবিক নিয়মেই প্রয়োগ হয়েছে।
নিতুন কুন্ডু নকশাবিদ, সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। এই প্রদর্শনীতে তাঁর চারটি ছাপাই ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে, যার দুটি কাঠখোদাই, অপর দুটি এচিং অ্যাকোয়াটিন্ট মাধ্যমে করা। কাজগুলো এর আগে কোথাও প্রদর্শিত হয়নি। জ্যামিতিক বিন্যাসে প্রকৃতি ও নগরকাঠামোর নির্মাণকেই সম্ভবত আঁকতে চেষ্টা করেছেন তিনি।
মাহমুদুল হকের এচিং হরাইজন, হ্যাপেনিং ১, ২ এবং ওয়াটারফল শীর্ষক কাজগুলোর কারিগরি দক্ষতা যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনি সামগ্রিকভাবে এই কাজগুলো তাঁর বাছাইকৃত উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যেই পড়ে বলে মনে হয়।
আবুল বারক আলভীর দুটি এচিং এ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। শিল্পী এই প্রদর্শনীকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। তাঁর দক্ষতা ও রচনাশৈলীর যে উচ্চতা আমরা নানা সময় লক্ষ করেছি, তার প্রতিফল এই কাজগুলোতে প্রকাশিত নয় বলে আমার ব্যক্তিগত মত।তার পরও একজন দক্ষ শিল্পীর যেকোনো নির্মাণ একটা স্তর অতিক্রম করেই, সে বিষয়টি তো থাকবেই।
রতন মজুমদার নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন নানা সময়ে। তবে শিল্পী হিসেবে তিনি জাত কাঠখোদাই শিল্পী। এবারের প্রদর্শনীতে তাঁর চারটি ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে, যাদের শিরোনাম হু অ্যান্ড হোয়াটএভার ইউ সে, ডিভাইডেড সোসাইটি-৫, সাবকনসাস ৪ ও ১। প্রথমে উল্লিখিত ছবিটিতে রেনেসাঁ যুগের ধ্রুপদি শিল্পী ও উত্তর প্রতিচ্ছায়াবাদী শিল্পীদের কাজের মিশ্র মেজাজ লক্ষ করা যায়। পরের কাজটি আরেকটু ভিন্নধারার, এটি উত্তর প্রকাশবাদী ও বিমূর্ত প্রকাশবাদী ধরনের মিশেলে একটি মেটাস্কেপ। ভাষার নির্মাণ ও গঠনে আপাত অস্থির তিনি, তারপরও এক ধরনের শক্তি ধারণ করেন তিনি মাধ্যমগত দক্ষতায়।
রোকেয়া সুলতানা পত্রপল্লবের জীবনকাব্যের অনুসন্ধান করেছেন। পাতার জীবনবৃত্তকে দেখতে চান তিনি জীবনের চলমানতায়। নানা রঙের ও আকৃতির পাতা ও বাকল ব্যবহার করেছেন তিনি ছাপচিত্র তৈরিতে। গভীর আবেগ ও অনুভূতি আছে কাজগুলোতে। এ টেলস অব এ লিফ ১, ২, ৩ ও ৪ শিরোনামের কাজগুলো স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।
রেখা ও জমির বিভাজন, বুনট বুট ও বর্ণের বিভিন্নতাই ওয়াকিলুর রহমানের কাজের মুখ্য বিষয়। একটি রেখা আকারে ও গঠনে যে অনুচ্চারিত অনুভূতির বয়ান করে, পরিচিত কাঠামো বা আকৃতি তাকে করে দেয় সীমিত। তাই শিল্পী তাঁর সৃষ্টিতে নির্দিষ্ট আকারের দায় থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন রেখা আর জ্যামিতির আধ্যাত্মিকতার প্রয়োগে।
রফি হক আপাদমস্তক রোমান্টিক একজন দৃশ্যনির্মাতা।এ প্রদর্শনীতে চারটি কাজ তাঁর প্রতিনিধিত্ব করছে। চারটিরই শিরোনাম আমি বৃত্ত আঁকি। এদের কোনোটিরই কোনো এডিশন নেই। কারণ, তিনি যে প্রক্রিয়ায় কাজ করেন, তাতে এডিশন করা হয়তো সম্ভব নয়। একে তো করেন কোলাজ, যাতে যুক্ত হয় ডায়েরি, বইয়ের পাতা বা কোনো অবজেক্ট, যার দ্বিতীয় কপি পাওয়া সব সময় হয়তো সম্ভবও নয়। আর এটিই হয়ে উঠেছে তাঁর কাজের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। এবারের প্রদর্শনীতে তাঁর কাজগুলোয় কোলাজের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন কাঠের ব্লক ইন্টাপ্লুওর আর ছাপাই কালির পরিবর্তে ব্যবহার করেছেন তেলরং।
তাঁর এবারের কাজগুলোর সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তিনি তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক রেখে শিল্পী মনিরুল ইসলামের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।
আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, প্রায়ই তাঁর কাজের সামনে গিয়ে ধাঁধায় পড়ে যেতে হতো যে এটা মনিরুল ইসলামের নয়, তাঁর কাজ।
সেই বিচারে এই কাজগুলো অবশ্যই তাঁর ল্যান্ডমার্ক কর্মের মধ্যে উচ্চারিত হবে।
রশিদ আমিন খেলা করতেন রেখার বুনন নিয়ে। চেনা বা পরিচিত কোনো আকার বা ফর্ম তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করত না, যা দর্শককে কোনো নির্ধারিত চেনা অবয়বের দিকে নির্দেশ করে। আগের কাজগুলোয় আমরা দেখতাম ক্ষিপ্র পৌরুষের মুক্ত প্রকাশ। তবে এবারের কাজগুলো সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। অচেনা অবয়বগুলো যেন এখন নির্দিষ্ট কোনো অবয়বের দিকে নির্দেশ করছে। তাঁর ভাষার কর্কশ ভাবের স্থানে যেন জায়গা করে নিচ্ছে কোমল ভাব। তিনি কি তাঁর প্রকাশভঙ্গি বিনির্মাণ করছেন?
আনিসুজ্জামান বিশাল আকৃতির দুটি প্রিন্ট করেছেন। ক্যালাইডোসকপিক কমপ্লেক্সিটি ৩৩ ও ৩৪ চিত্রে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে ঢাকা শহরের অর্গানিক বিকাশ ও তার কাঠামোগত জটিলতার রূপের নান্দনিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। কাঠখোদাইয়ে দক্ষ যেসব তরুণ শিল্পীর নাম অগ্রগণ্য, আনিস অবশ্যই তাঁদের মধ্যে প্রধান সারিতেই অবস্থান করেন এবং এবারের কাজেও তার ছাপ স্পষ্ট। নগরবাসী বর্মণকে আমরা চিনি নিমগ্ন ধ্যানী এক শিল্পী হিসেবে। কাজের ধরনে নয়, বরং নিমগ্নতার কারণে তাঁর কাজ দেখলে আমার মনে পড়ত ধ্যানী শিল্পী গণেশ পাইনের কথা। কিন্তু তাঁর এবারের কাজগুলো যেন সেখান থেকে কিছুটা সরে গেছে। একটু লক্ষ করে দেখতে চাইলাম বিষয়টি মাধ্যমগত কারণে কি না। বাস্তবে আমার মনে হয়েছে, তিনি বেশ প্রভাবিত হয়েছেন কালিদাস কর্মকার দ্বারা, যা তাঁর কাজের বর্ণপ্রয়োগ থেকে বিন্যাসকাঠামোকে বদলে দিয়েছে।
এবার অনুজতম শিল্পী শেখ মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান প্রসঙ্গে আসি। তাঁর চারটি কাজ আছে এই প্রদর্শনীতে, যাঁরা শিরোনামহীন, ভূচিত্র, নৌযাত্রা ১ ও ২। বিষয়-বৈচিত্র্যে, উপস্থাপনায়, চিন্তা ও মননে একটি সমন্বিত ভাষা-গঠন-পথে হাঁটছেন তিনি। বুদ্ধি, করণকৌশল আর আবেগের পরিণত প্রয়োগবলে তিনি বহুদূরের যাত্রী। কায়ার এই প্রদর্শনী দর্শকের কাছে বেশ সময় দাবি করে। কারণ, প্রতিটি ছবির বাছাই, উপস্থাপনা ও গভীরতা আলাদাভাবে মনোযোগ চায়। ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এই প্রদর্শনীর মান আমাদের উৎসুক করেছে আগামী আয়োজনটির জন্য। আমিসহ অনেক দর্শকই হয়তো আগ্রহভরে অপেক্ষা করবেন পরের আয়োজনটি দেখার জন্য।