২৮ জানুয়ারি, ২০১৩: গুপ্তধনের খোঁজে—মাহবুব আলম
প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
দাম: ২৩০ টাকাlপৃষ্ঠা: ১৪৪
ইতিহাসনিয়ে বহু পুরোনো কথা এই যে ‘ইতিহাসে পরাজিত মানুষের কথা লেখা থাকে না।’ তবে সাব অলটার্নবাদীরা এখন নানা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এই কথাকে এক রকমধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। সমাজ-সভ্যতার গলিপথে ঢুঁ দিয়ে দেখিয়েছেন, জয়-পরাজয়েরবাইরে ইতিহাসের অন্য উঠোনও আছে। সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে মাহবুব আলমের গুপ্তধনেরখোঁজে বইটি পড়তে গিয়ে পাওয়া গেল ইতিহাসের মধ্যে আলো-আঁধারে থাকা পার্শ্বইতিহাসকে। যেমন, বাংলার স্বাধীন সুলতান শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ চীনের মিংসম্রাট ইয়োং-লোকে একটি জিরাফ উপহার পাঠিয়েছিলেন—এই সাদা-কালো তথ্যকেউপজীব্য করে ‘বাংলার সুলতান, চীনের সম্রাট, আফ্রিকার জিরাফ’ নামে বইয়েরপ্রথম প্রবন্ধে তিনি যেমন চৈনিক সভ্যতার সঙ্গে বাংলা মল্লুকের যোগাযোগকেখোলাসা করেছেন, তেমনই চীনের ধর্ম-দর্শন, সংস্কারগুলোও অলিখিত থাকেনি। কেবলএই রচনাতেই নয়, বইয়ের ১২টি প্রবন্ধেই ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের অনালোচিত টুকরাটুকরা নানা প্রসঙ্গ, পার্শ্ব ইতিহাস।
বইটির শিরোনামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেএকটি পঙিক্ত, ‘ইতিহাসের বিচিত্র সরস কাহিনি’। হ্যাঁ, ‘বিচিত্র সরসকাহিনি’ই বটে! তাই তো ‘বিদ্রোহী যুবরাজ শাহজাহান ঢাকায়’ শীর্ষক রচনায় জানাযাচ্ছে, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর বিদ্রোহী পুত্রশাহজাহানকে ‘বিদৌলত’ বা ভাগ্যহীন নামে সম্বোধন করেছিলেন। অথবা ‘নিজেরচরকায় তেল দাও’ শিরোনামে লেখায় এই প্রবাদটি নিয়ে কথা পাড়তে পাড়তে লেখক যখনবলে যান বাঙালির চরকা-কাহিনির আদ্যোপান্ত ও সমাচার দর্পণ-এর বরাত দিয়েশান্তিপুরের এক অসহায় চরকা-কাটুনির প্রসঙ্গও যখন অনুল্লিখিত থাকে না, তখনবইটিকে অন্য রকম সম্মান না দিয়ে উপায় কী!
লেখক মাহবুব আলম ইতিহাস নিয়েনাড়াচাড়া করছেন দীর্ঘদিন। বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘পাঠ্যবইয়ের গণ্ডিপেরিয়ে প্রশস্ত রাজপথ ছেড়ে শুরু হলো ইতিহাসের মেঠোপথে ঘুরে বেড়ানো।…হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ে দেখা না-দেখা নানা চরিত্র, জানা যায় নানা তুচ্ছকাহিনি, যার ভেতর বিগত দিনের মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতি ভেসে ওঠে। রবীন্দ্রনাথযাকে বলেছেন ইতিহাসের চূর্ণ।’
‘ইতিহাসের চূর্ণ’ হাতড়াতে গিয়েই যেন-বাতিনি পেয়েছেন গুপ্তধন। রচনা করেছেন গুপ্তধনের খোঁজে। এই বইয়ে ইতিহাস উঠেএসেছে অনেকটা গল্পের আদলে। সেই সঙ্গে লেখকের অনুপম ভাষাভঙ্গি একে নিয়ে গেছেঅন্য উচ্চতায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, ‘নিজের চরকায় তেল দাও’ প্রবন্ধেইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের কারণে বাংলার চরকাজীবীদের দুরবস্থার বর্ণনা দিতেগিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘সেখানে কলের যুগ শুরু হওয়ায় সুদূর বাংলারসুতা-কাটুনিদের ভরা জোয়ারের সংসারে মরা কটাল নেমে এল।’
বিষয়বস্তু, তথ্য-উপাত্ত এবং বয়ানকৌশল—সব দিক থেকে গুপ্তধনের খোঁজে গ্রন্থটি পাঠককে প্রকৃতই গুপ্তধনের খোঁজ দেবে।