২৪ জানুয়ারি, ২০১৩।।
বহু আলোচনা-সমালোচনার পর শেষ পর্যন্ত, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে রাজপথে অমানবিকভাবে পেটানোর নায়ক, পুলিশের বিতর্কিত উপকমিশনার (ডিসি) হারুনকে প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেছেন, ফারুককে পেটানোর কারণেই এই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক দেয়া হয়েছে। ডিসি হারুন স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে সেদিন বিরোধী দলের চিফ হুইপ ফারুকের নেতৃত্বে রাজপথের বিশৃঙ্খলা রুখে দিয়েছিল, তিনি আরো বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখায় হারুনকে প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক দেয়া হয়েছে। প্রশাসনে তার মতো সাহসী পুলিশ কমিশনার থাকলে দেশে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারবে না।’
২০১২ সালে রাজপথে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে ওই পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশিদ যেভাবে বিরোধী দলের চিফ হুইপ ফারুককে পিটিয়েছিলেন, তা সে সময় সবমহলে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সরকারের এ ধরনের ভূমিকা প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে। পুলিশের এরকম অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সেদিন সোচ্চার প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে। ঘটনার জন্য দায়ী ডিসি হারুনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ারও তখন জোর দাবি ওঠে। কিন্তু তাকে শাস্তি না দিয়ে, বরং পুরস্কার হিসেবে পদ-পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি, এরই ধারাবাহিকতায় সব বিবেকবান মানুষকে অবাক করে এবার তাকে দেয়া হলো প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক। নজিরবিহীন এ ঘটনা পুলিশ বাহিনীকে ক্ষমতার সঙ্কীর্ণ স্বার্থে ব্যবহারের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পাবে। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই যে এবার তাকে এই পদক দেয়া হয়েছে, তা সবার কাছে স্পষ্ট। সাংবাদিকদের তোলা প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ২০১২ সালে হারুনের ‘অনেক উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম’ রয়েছে, এজন্য তাকে পদক দেয়া হয়েছে।
সবিশেষ উল্লেখ্য, ২০১২ সালে জাতির জন্য ডিসি হারুণের একটি ‘অসাধারণ’ অবদানের কথা দেশবাসী সবারই জানা। কারণ, সেই ঘটনাচিত্রটি দেশবাসীর মানসপটে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। কিছু দিন আগে পুরান ঢাকায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে নির্মমভাবে কুপিয়ে যখন নির্দোষ বিশ্বজিৎকে হত্যা করে, সে সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এই বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা। খুনিদের নিবৃত্ত না করে তিনি ও তার সাথে থাকা একদল পুলিশ নীরবে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। হারুনকে পদক দেয়ার ক্ষেত্রে তার এই কথিত সাফল্য বিবেচনায় নেয়া হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে কোনো মন্তব্য করেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এ ধরনের সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা থাকলে দেশে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারবে না।’ কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, এ ধরনের দলবাজ পুলিশ কর্মকর্তা থাকলে দেশে কখনো আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হবে না। বরং রাজনৈতিক দমনপীড়ন, হত্যা, গুম, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধ দিন দিন বাড়বে। পুলিশকে দেখা যাবে সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের সহযোগীর ভূমিকায়। ছাত্রলীগ পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে বিরোধীদলের ছেলেদের ওপর গুলি চালাবে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে যখন প্রতিপক্ষের ওপর গুলি ও হামলা চালায়, তখন কি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনা ঘটে না? এ সময়ের ‘সাহসী’ পুলিশ কর্মকর্তা হারুনেরা তখন কোথায় থাকেন?
দেখা যাচ্ছে, বিরোধী দলের বক্তব্যই সঠিক। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ফারুককে পেটানোর ঘটনায় হারুনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে, সরকার পুলিশ বাহিনীকে দলীয় সংগঠনে পরিণত করেছে।’
আমরা মনে করি, ডিসি হারুনকে পদক দেয়ার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একগুঁয়েমিই কাজ করেছে। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, পুলিশ পদকপ্রাপ্তদের জন্য কমিটি যে ৬৬ জন পুলিশ সদস্যের তালিকা তৈরি করেছিল, তাতে ডিসি হারুনের নাম ছিল না। কমিটির অসম্মতি সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনেকটা চাপ সৃষ্টি করে ডিসি হারুনের নাম পদক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। এতে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় বলে এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
গোটা বিষয়টিই আজ তীব্র বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত করা হলো। ডিসি হারুনের পদক তালিকায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে কার্যত প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদকের মর্যাদাকে ুণœ করা হয়েছে।