ঐতিহ্যের মসলিন শাড়িসহ ৫শ’ নিদর্শনের প্রদর্শন জাদুঘরে

0
160
Print Friendly, PDF & Email

ঢাকা (২৩জানুয়ারী) : ‘মসলিন’ শাড়ি, বাঙলার গৌরবোজ্জল ইতিহাসের এক অনন্য উপাদান। এক সময় বাঙালির সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীদের অহঙ্কারের এ উপাদানটি জদুঘর ছাড়া পাওয়া যায় না অন্য কোথাও। বিশ্বের অন্তত দু’টি জাদুঘরে রক্ষিত রয়েছে এ মসলিন।

বাঙালির এ গর্বের উপাদান মসলিন শাড়িসহ বেশ কিছু ঐতিহ্যময় নিদর্শন স্থান পেয়েছে জাতীয় জাদুঘরের এক প্রদর্শনীতে।

জাতীয় জাদুঘরের শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।

অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের এমএলএ এবং জুরি বোর্ডের সদস্য, ঢাকা পৌরসভার ৪৫ বছরের নির্বাচিত কমিশনার ও বাইশ পঞ্চায়েতের সর্দার আল্লাহ বক্স সরকারের পুত্রবধূ ছিলেন জাহানারা খাতুন।

জাহানারা খাতুনের স্বামী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ক্রীড়াবিদ মনসুর রহমান ১৯৩০ সালে নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে একটি মসলিন শাড়ি সংগ্রহ করে কোন এক পহেলা বৈশাখে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। জাহানারা খাতুন ২০০০ সালে শাড়িটি জাতীয় জাদুঘরে উপহার হিসেবে তুলে দেন।

মসলিন শাড়ির উপহারদাতা সমাজ হিতৈষী জাহানারা খাতুনের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘর ও জাহানারা ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে এ প্রদের্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রদর্শনী শুরু হয় ১৪ জানুয়ারি।

জাহানারা খাতুনের ছেলে সুলতান মাহমুদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, “প্রদর্শনীতে তার দাদা, বাবা-মা’র বিভিন্ন সামগ্রীসহ স্থান পেয়েছে প্রায় পৌনে দুইশ’ বছরের বিভিন্ন উপাদান।”

প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে জাহানারা খাতুনের বিয়ের রৌপ্য-স্বর্ণখচিত বিয়ের বেনারসি শাড়ি, ওড়না, জুতা, গায়ে হলুদ ও মেহেদীর শাড়ি।

জাহানারা খাতুনের পুতুল খেলার সরঞ্জামাদি ও বিয়ের উপহারের খাট-পালং, আলমিরা, চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে তাঁর স্মৃতিকে।

জাহানারা খাতুন, তাঁর শ্বশুর এবং ছেলে-মেয়েদের সংগৃহীত রুপা-ধাতব-চীনা মাটির দারু-মৃৎ-বস্ত্র শিল্পের উপাদান, নকশীকাঁথা, ব্রিটিশ-ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের ধাতব মুদ্রাসহ প্রায় পাঁচশ’ নিদর্শন। রয়েছে ১ ইঞ্চির ৩০ পারা কোরআন শরীফ, কাবা ঘরের গিলাপের অংশ বিশেষ, সাপের চামড়া, হরিণের শিং।

এছাড়াও রয়েছে আল্লাহ বক্স সরকারের শেরওয়ানি ও চশমা। স্থান পেয়েছে জাহানারা খাতুনের পরিবারের সদস্যদের ছেলেবেলার বিভিন্ন জিনিসপত্র।

জাহানারা খাতুনের মেয়ে ও জাহানারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জিনাত পারভীন বাংলানিউজকে বলেন, “তার মা ছিলেন সৌখিন প্রকৃতির। যত্ন করে সেসব জিনিসপত্র তিনি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি স্বপ্ন দেখতেন এসব সামগ্রী যত্ন করে রাখার। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে জাহানারা ফাউন্ডেশন গঠন করে সংরক্ষিত উপাদান নিয়ে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।”

১৪ জানুয়ারি জাহানারা খাতুনের সংরক্ষিত ১৫ ধরনের ২৬টি নিদর্শন জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে জাহানারা ফাউন্ডেশন। এর কিছু উপাদান জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে।

এদিকে একজন ব্যক্তির সংরক্ষণ করা উপাদানের প্রদর্শনীতে দর্শকের ঢল নেমেছে। দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে দেখতে আসছেন অবিভক্ত বাঙলাসহ বর্তমান কালের বিভিন্ন জিনিসপত্র। তবে সবার দৃষ্টি কাড়ে মসলিন শাড়ি।

বলা হয়, ঢাকার মসলিন শাড়ির ঐহিত্য ছিলো দুনিয়াজুড়ে। মোঘল সম্রাট ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এ কাপড় ব্যবহার মসলিন শিল্প প্রসারে ব্যাপক সহায়তা করেছে।

ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী এলাকায় ‘ফুটি’ নামের এক ধরনের উন্নতমানের তুলা জন্মাতো। সেই তুলা দিয়ে তৈরি হতো মসলিন। দিনে দিনে সারা পৃথিবী জয় করে নেয় এই কাপড়। তবে ইউরোপে এ কাপড়ের চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি।

১৮৫১ সালে লন্ডনের এক প্রদর্শনীতে মসলিন প্রাধান্য পায়। তবে কলের তৈরি কাপড়ের সঙ্গে টিকতে না পেরে এখন তা ইতিহাস হয়ে উঠেছে।

তবে মসলিন কাপড়ের ইতিহাস হওয়ার পিছনে রয়েছে আরও রোমহর্ষক কাহিনী। এ শিল্পের কারিগর ছিলো ঢাকার ১২ থেকে ১৮ বছরের কুমারীরা। তাদের কোমল হাতের সুক্ষ্ম ছোঁয়ায় তৈরি হতো এ কাপড়। ব্রিটিশরা এ শিল্পকে ধ্বংস করতে কারিগরদের আঙুল কেটে দেয়।

জাহানারা খাতুনের ছেলে সুলতান মাহমুদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, “তার মা শাড়িটি জাদুঘরে দেওয়ার সময় একটি আংটির মধ্যে ঢুকিয়েও দেখিয়েছেন সে সময়।”

সে কারণে প্রদর্শনীতে রাখা শাড়িটির কিছু অংশ ছিড়ে গেছে। তবে এটি নিয়ে গবেষণা করে বাঙলার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন সুলতান মাহমুদুর রহমান।

ভারতের নদীয়ার শান্তিপুর থেকে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে প্রদর্শনীতে এসেছেন আশিষ কুমার সরকার।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “মসলিন আমাদের উপ-মহাদেশের গর্ব। যে কোনভাবেই এ ঐহিত্যকে সংরক্ষণ করা উচিত।”

জাহানারা ফাউন্ডেশনের পক্ষে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দুর্লভ দুটি মসলিন শাড়ি রয়েছে। এ শাড়ি আমাদের গর্ব।

বগুড়ার সোনাতলার তেকানী হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জাদুঘরে এসে মসলিন শাড়িসহ অন্যান্য প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হন।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।”

সপ্তাহব্যাপী এ প্রদর্শনী চলার কথা থাকলেও ব্যাপক দর্শক সমাগমের কারণে বুধবার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলে জানান আয়োজকরা।

নিউজরুম

শেয়ার করুন