ঢাকা (২৩জানুয়ারী) : জাতীয় চার নেতা হত্যা ( জেল হত্যা) মামলার আপিল শুনানিতে সাক্ষীদের সাক্ষ্য উপস্থাপন শেষ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ।এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার দিন ধার্য করেছেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় সদস্যের বেঞ্চ।
বুধবার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেলের মর্যাদায় নিযুক্ত রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম । এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. নাসিম।
অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান, ‘‘বুধবার মোট তিন সাক্ষীর দেওয়া সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছি। তারা হচ্ছেন কর্নেল শাফায়েত জামিল, তৎকালীন বিশেষ শাখার ডিআইজি ই এ চৌধুরী এবং এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দ।’’
তিনি বলেন, ‘‘হাইকোর্টের রায় বিকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। আমরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে তা আদালতের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারবো।’’
মাহবুবে আলম বলেন, ‘‘সাক্ষীদের সাক্ষ্য উপস্থাপন শেষ হয়েছে। এরপর যুক্তিতর্ক হবে। তারপর আশা করি, রায় হতে আর বেশি সময় লাগবে না।’’
মো. নাসিম বলেন, ‘‘আমরা ন্যায়বিচার চাই। আশা করি, ন্যায়বিচারের মাধ্যমে এ আপিল নিষ্পত্তি হবে। আত্মস্বীকৃত খুনিদের মৃত্যুদণ্ড হবে বলেও আশা করছি।’’
এর আগে ১৫ জানুয়ারি ও ২২ জানুয়ারি মঙ্গলবার আপিল বিভাগে সাক্ষীদের সাক্ষ্য উপস্থাপন করেন আনিসুল হক।
২২ জানুয়ারি শুনানির পর আনিসুল হক বলেন, ‘‘এ মামলার ৬৪ জন সাক্ষীর দেওয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী বোঝা যায়, বঙ্গভবনে ষড়যন্ত্র হয়েছে। আর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কেন্দ্রীয় কারাগারে। আর ওইদিন মেজর ডালিম দুপুরে কারাগার পরিদর্শন করেছেন। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছেন, এ চার নেতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠন করতে পারেন। তাই তাদেরকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কারাগারে হত্যা করা হয়েছে। সাক্ষীদের এসব সাক্ষ্যের মাধ্যমে এ ঘটনার একটি চিত্র আমি আপিল বিভাগে উপস্থাপন করেছি।’’
১৫ জানুয়ারি শুনানির পর আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘ওইদিন চার সেনা কর্মকর্তা সশস্ত্র অবস্থায় জেলখানায় আসেন। বঙ্গভবন থেকে টেলিফোন করে তারা যা করতে চান, তা করতে দিতে বলা হয়।’’
তিনি বলেন, ‘‘এই মামলার দু’টি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে, অপরাধ সংগঠন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ষড়যন্ত্র। সশস্ত্র সেনা কর্মকর্তারা কারাগারে এসে চার নেতাকে গুলি করে হত্যা করেন। পরে অপর একটি দল এসে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। বঙ্গবভবনে ষড়যন্ত্রের বৈঠক এই দুই দল সেনা কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। তাই এদিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
কারা সেখানে যাবেন, সেটা চূড়ান্ত হয় বঙ্গভবনের বৈঠকে। ওই ঘটনার আগে মেজর গালিব এসে আওয়ামী লীগ নেতারা কোথায় আছেন, তা দেখে যান। পরে মেজর ফারুক বঙ্গভবন থেকে ফোন করে আবার জানতে চান, তাদেরকে কোথায় রাখা হয়েছে?’’
উল্লেখ্য, জেলহত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের করা আপিল শুনানির জন্য আপিলের সংক্ষিপ্ত সার (concise statement) তৈরি করে গত বছরের ৩১ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে জমা দেন রাষ্ট্রপক্ষ। মামলার অ্যাটর্নি জেনারেলের মর্যাদায় নিযুক্ত রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর আনিসুল হক অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে আপিলের ওই সংক্ষিপ্ত সার জমা দেন। গত ১ নভেম্বর তা আদালতে দাখিল করেন আদালতে জমা দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
এর পর গত ৪ নভেম্বর সংক্ষিপ্তসার গ্রহণ করে ১১ ডিসেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। ওই দিন মাহবুবে আলমের আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানি একদিন মুলতবি করেন। ১২ ডিসেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যা (জেলহত্যা) মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের করা দুই পলাতক আসামি দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে নতুন করে নোটিশ না দেওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে তাদেরকে নতুন করে নোটিশ না দিয়ে পলাতক হিসেবেই গণ্য করে এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের করা শুনানির জন্য আপিল ১৫ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয় ।
প্রসঙ্গত, বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি শেষে বহু প্রতীক্ষিত জেলহত্যা মামলারও চূড়ান্ত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হলে গত বছরের ৭ নভেম্বর আপিল আবেদনের শুনানি শুরু হয়।
২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি সরকারের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদনের অনুমোদন দেন।
একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষকে আপিল দায়েরের অনুমতি দিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে সংক্ষিপ্ত সার (concise statement) জমা দিতে বলেছিলেন আদালত। ওই আদেশের ১ বছর ৮ মাস পরে সেই সংক্ষিপ্ত বিবরণী জমা দেন রাষ্ট্রপক্ষ।
বিলম্ব হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর আনিসুল হক সে সময় সাংবাদিকদের জানান, ‘‘এই মামলায় ৬৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ছিল। তাদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে এর সংক্ষিপ্তসার তৈরিতে সময় লেগেছে। সংক্ষিপ্ত আবেদনে আমরা নিম্ন আদালতের রায় বহাল চেয়েছি।’’
জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেও হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের আদেশ দেওয়া হয়। আত্মসমর্পণ না করলে তাদের গ্রেফতার করার জন্যও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি নির্দেশ ছিলো আদালতের।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয়।
নিউজরুম