২৩ জানুয়ারি, ২০১৩।।
একটি সহযোগী দৈনিক যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকার বরাত দিয়ে জানিয়েছে, আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বাদ দেয়ার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এটি করা হলে বাংলাদেশ আমেরিকান বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্যের প্রবেশাধিকার হারাবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে দেয়া জিএসপি সুবিধা পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে, নাকি এ সুবিধা সীমিত করা হবে অথবা স্থগিত রাখা হবে, তা আগামী বসন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নও যাতে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত না নেয় সে ল্েয বাংলাদেশ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়, শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার করলে তা হয়তো রাতারাতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশে অর্ডার না-ও দিতে পারেন। ইতোমধ্যে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান নাইকি কাজটি করতে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের কোনো পোশাকেরই শুল্কমুক্ত বাণিজ্য প্রবেশাধিকার নেই। বাংলাদেশের যে ৪৮০ কোটি মার্কিন ডলারের বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে, তার মধ্যে মাত্র শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পায়। এত অল্প পরিমাণ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও যুক্তরাষ্ট্র সবসময় বাংলাদেশকে কঠোর শর্তে রেখেছে। বিশেষ করে কারখানার কাজের পরিবেশমান বজায় না থাকলে দেশটি জিএসপি সুবিধা বাতিলের কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের জন্য আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয়ার কথা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দফতর-ইউএসটিআরের। গত নভেম্বর মাসে তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তৈরী পোশাক শিল্পকারখানার কাজের পরিবেশ উন্নত করার তাগিদ দিয়ে আসছিল। গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি কমছে। তবে তুরস্ক, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের পোশাক রফতানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। তবুও একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি তৈরী পোশাক রফতানি করে থাকে। বাংলাদেশের রফতানিকারকেরা ১৫ শতাংশেরও বেশি শুল্ক দিয়ে এ পণ্যটি রফতানি করে থাকেন। জিএসপি নিয়ে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকদের আশঙ্কা বেশি ইউরোপীয় বাজার নিয়ে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের শত ভাগ বিনা শুল্কে যাচ্ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে মোট এক হাজার ১৩৭ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে দেয়া বাংলাদেশী পণ্যে জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের চেয়ে অনেক বড় বিপদ নিয়ে আসবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়া হলে। আমেরিকা সাধারণভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ব্যাপারে যে নীতি নেয়, ইউরোপ অনেকটা সেটাই অনুসরণ করে। বাংলাদেশ ইউরোপ বা আমেরিকায় রফতানি ক্ষেত্রে যে অগ্রাধিকার সুবিধা পাচ্ছে তা মূলত লাভ করছে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে। এ তালিকা থেকে বাংলাদেশকে বের করে দেয়ার মানে হলো বিশ্বের কোনো বাজারে আর এই বিশেষ রফতানি সুবিধা পাওয়া যাবে না। এর চেয়ে বড় বিপদ আসবে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন রেয়াতি ঋণদাতা দেশ ও প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র সুদে ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে। এমনিতেই যে তিনটি মানদণ্ডে কোনো দেশকে স্বল্পোন্নত হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তার প্রায় সবটাতেই বাংলাদেশ উচ্চতর রেখার কাছাকাছি অবস্থান করছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করছে, দেশটির ভঙ্গুরতা কমছে বলে বিভিন্ন বিশ্বমিডিয়ার রিপোর্টে, দাতাগোষ্ঠী ও সংস্থার শীর্ষব্যক্তিদের মন্তব্যে আমরা খুশি হচ্ছি। কিন্তু এসব যে এলডিসি থেকে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে রফতানি ও ঋণবাজারে মুক্ত প্রতিযোগিতায় ফেলে দেবে, সেটা ভাবা হচ্ছে না।
আমরা মনে করি, আমেরিকান কংগ্রেসে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা পুনর্মূল্যায়নের যে উদ্যোগ, সেটি নিছক তাজরীন গার্মেন্টের একটি অগ্নিকাণ্ডের জন্য নয়। এর পেছনে বাংলাদেশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অনেক বিষয় যুক্ত আছে। ফলে সরকারকে সার্বিকভাবে বিষয়টি মূল্যায়ন করতে হবে। আর বিপদ ইইউ থেকে আসার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। ইউরোপীয় সংসদে বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ সংবলিত প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়ার অবশ্যই একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সরকারকে সার্বিক বিষয় বিবেচনায় রেখে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে বাংলাদেশ এর রফতানি ও ঋণবাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে। ইউরোপ-আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনোভাবেই অকারণে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া উচিত হবে না বাংলাদেশের জন্য।