শিক্ষা ডেস্ক(২২ জানুয়ারী): স্কুলের পরীক্ষা আর গণিত অলিম্পিয়াডের মধ্যে পার্থক্য কী?
সঞ্চালকেরএমন প্রশ্নের জবাবে উঠে দাঁড়াল প্রাথমিক স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী রোজা।উত্তরটা যেন তার তৈরি ছিল আগে থেকে। ফোকলা দাঁতে তার উত্তরটা এমন ‘আমরাগণিত অলিম্পিয়াডে আসি ভালোবেসে। কিন্তু স্কুলের পরীক্ষায় অংশ নিই ভয়েভয়ে।’
এমন সব প্রশ্ন-উত্তরে জমজমাট হয়ে ওঠে এবারের গণিত উৎসবেরউদ্বোধনী মঞ্চ কুমিল্লা। গত ২৮ ডিসেম্বর কুমিল্লার উদ্বোধনী উৎসবের পরদিনইছিল ফেনীর উৎসব। সেখানেও সকাল থেকে গণিতপাগল শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখরহয়ে ওঠে ফেনী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ।
কুমিল্লা আর ফেনীর পরহয়ে গেছে উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও বগুড়ার উৎসবও। দক্ষিণবঙ্গেরটাওশেষ হয়ে কালথেকে শুরু হবে মধ্যবঙ্গের আয়োজন।
আনন্দে উদ্বোধনে
কুয়াশারপর্দা পেরিয়ে কুমিল্লা উৎসবে সকাল আটটার আগেই হাজির অনেক শিক্ষার্থী।ঠান্ডায় তখন বাইরে যাওয়াই দুষ্কর। মায়ের সঙ্গে উৎসবে আসা রোহান রাফসানজানায়, ‘গণিত উৎসবে এলে আমার মনটাই ভালো হয়ে যায়। আমার ইচ্ছা ছিল এবারযেন কোনো পর্ব মিস না করি। তাই সকাল সকাল চলে এসেছি।’ সকাল নয়টার আগেইউপস্থিত কয়েক শ ছেলেমেয়ে। সাড়ে নয়টায় বেজে উঠল উৎসবের ঘণ্টা। শুরু হলোউদ্বোধনী উৎসব। শিক্ষার্থীরা লাইন করে দাঁড়ানোর পর শুরু হলো জাতীয়সংগীত। সেই সঙ্গে পতাকামঞ্চে উঠে পতাকা তুললেন অতিথিরা।
ঢাকের তালে তালে
সকালেশিক্ষার্থীদের আগমন উপলক্ষে ঢাকের বাড়িতে মুখর হয়ে ওঠে সারা এলাকা।ঢাকের তালে অনেকে দুলতে থাকে উৎসবের আনন্দে। উদ্বোধনের পর শিক্ষার্থীরাসারিবদ্ধভাবে এগোতে থাকে পরীক্ষা কেন্দ্রের দিকে। সবখানেই পরীক্ষার রুমেশিক্ষার্থীরা প্রবেশ করে একরাশ আনন্দ আর ভালোবাসা নিয়ে।
অগ্নিপরীক্ষা!
শিক্ষার্থীরাপরীক্ষার হলে যেন ডাল-ভাত খেতে বসেছে। এমন একটি ভাব সবার মধ্যে। তবেপরীক্ষা শুরু হওয়ার পরপরই যেন আলাদা চিত্র। সবার চোখই তখন একপাতা কাগজেআটকে আছে। এর মাঝে কেউ আবার শুধু কলম কামড়েই সময় পার করছে। কেউ বা আবাররাফ কাগজে হিজিবিজি লিখেই যাচ্ছে। অনেককে দেখেই মনে হচ্ছে, কালি শেষ নাহওয়া পর্যন্ত এ লড়াই চলবেই। কিন্তু কলমের কালি নয়, সবাইকে থামতে হলোসময়ের কাছে। এক ঘণ্টা ১৫ মিনিট মাথা খাটিয়ে সবাই ফিরে এল বাইরের আলোবাতাসে।
প্রশ্নোত্তরে সরগরম
পরীক্ষার পর অনেকেই ঘুরে দেখল পাশেরবুথগুলো। কেউ আবার বাইরে এসেও বোঝার চেষ্টা করছে নিজের উত্তরটা ঠিক হলো কিনা। এরপর শুরু হয় শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব। এখানে অনেকেইপ্রশ্নের বাণে ভাসিয়ে তোলেন মঞ্চে থাকা শিক্ষকদের। কুমিল্লা উৎসবে প্রশ্নছিল এমন—‘বিগ ব্যাঙ আসলে কী?’ অথবা ‘সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল কেননেগেটিভ হতে বলা হয়, এটা আসলে কী?’ ফেনী উৎসবে উপস্থিত ছিলেন সবার প্রিয়মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাই অটোগ্রাফ শিকার তো ছিলই, ছিল স্যারের কাছে নানাপ্রশ্ন।
উৎসব গণিতের হলে কীহবে আগ্রহ তো সব বিষয়েই। তাই প্রশ্নোত্তরপর্বে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, মহাকাশ হয়ে শরীর কিংবা চিকিৎসাশাস্ত্রকোনোটাই বাদ যায় না। এমনকি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানা দিক নিয়েওশিক্ষার্থীরা তাদের ভাবনা তুলে ধরে। আবার প্রধানমন্ত্রী হলে কীকরবে—এমনপ্রশ্নের জবাবে শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই শিক্ষা সংস্কার, দুর্নীতি উৎখাতএবং সবার জন্য সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে।
প্রশ্নোত্তরের সময়ে
যেইসময়টাতে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে, ঠিক সেই সময়ে একদল মগ্ন থাকে বদ্ধঘরে।একাডেমিক টিমের সমন্বয়ে এখানে চলে খাতা দেখার আয়োজন। উৎসবে শিক্ষার্থীরাএকটি প্রশ্নের উত্তর দেয় নানা ঢঙে। আর তা নিয়ে খাতা দেখার কক্ষে চলতেথাকে সরগরম আলোচনা।
খাঁজকাটা, খাঁজকাটা
প্রথম পাঁচটি উৎসবেরসঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির একাডেমিক কাউন্সিলরতামিম শাহরিয়ার। সঞ্চালনার পাশাপাশি বিভিন্ন উৎসবে তাঁর কণ্ঠে কুমিরেরখাঁজকাটা লেজের গল্প সবাই উপভোগ করে। বগুড়ার উৎসবে গণিত ক্যাম্পের বর্ণনাকরতে গিয়ে তামিম একটি গান বিভিন্ন সুরে গেয়ে শোনান। নানা মজাদারবক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদকশিক্ষার্থীদের গণিতে নিজেদের দক্ষ করার একটি সহজ পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। তিনিজানান—গণিতে ভালো করতে হলে পাঠ্যপুস্তকের অধ্যায়ের শুরুতে দেওয়াবক্তব্যগুলো প্রথমে ভালোভাবে পড়তে হবে। এরপর নিজে নিজে উদাহরণ এবং পরেঅনুশীলনীর সমস্যার সমাধান করতে হবে। যেসব সমস্যা পারা যাবে না সেগুলোচিহ্নিত করে এগিয়ে যেতে হবে। পরের অধ্যায় শেষ করার পর পুনরায় ফিরে এসেওই সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায়।এভাবে বছরের মাঝখানেই নিজের ক্লাসের গণিতেরবই শেষ করে ফেলা যায়।
ঢাকার টিকিট বুঝে নিতে
অনুষ্ঠানের শেষদিকে ছিল এক মিনিট পর্ব। আর এক মিনিট পর্ব মানেই তো পুরস্কারপ্রাপ্তদেরতালিকা জানার সময়। কারণ, এক মিনিট পর্বে স্যারদের আলোচনার পরপরই গরম গরমচায়ের মতো জানিয়ে দেওয়া হয় পুরস্কার পাওয়াদের নাম। এই সময়টাশিক্ষার্থীদের দেখা যায় অন্য রকম মেজাজে। কেউ বসে বসে পায়ের তলায় মাঠেরঘাস পিষছে তো কেউ হাতের কলম কামড়াচ্ছে। একেকটি নাম যায় আর টেনশন বাড়তেথাকে অন্যদের। নিজের নামটি শুনেই ভোঁ-দৌড় মঞ্চে। এর বাইরেও অনেকের মনখারাপ, কেউ বা আবার আগামী বছরের জন্য প্রস্তুত হতে চায়। কুমিল্লার নওয়াবফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মালিহা নূর বলে, ‘এবার আমি প্রথম আসলাম। তবে আগামীবার ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই আসতেচাই।’
দেখা হবে বিজয়ে
সব উৎসবের বিজয়ীরা ঢাকায় জাতীয় উৎসবেযোগ দেবে। তবে, গণিত উৎসব কোনো প্রতিযোগিতা নয়। সে কারণে, উৎসবে সবাইবিজয়ীহয়। তারা যখন ফিরে যায়, নিজের স্কুলে, বাড়িতে তখন তারা এগিয়েযাওয়ার নানা রসদ নিয়ে ফেরে। তারা জেনে যায়, দেশকে ভালোবাসতে হলে সেটিকেময়লা করা যায় না; দেশকে ভালোবাসার জন্য প্রতিদিন মাকে খুশি করতে হবে এবংএকুশ শতকের লড়াইয়ে বিজ্ঞান আর গণিত হলো দিন বদলের সত্যিকারের হাতিয়ার।
সে হাতিয়ারকে সঙ্গী করেই তারা একদিন বাংলাদেশকে সোনার বাংলা বানাবে।
জয় হোক গণিত উৎসবের।
নিউজরুম