শিক্ষা ডেস্ক(২১ জানুয়ারী):
রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সাত ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়ার আট দিন পর জারি করা প্রজ্ঞাপন নিয়ে বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।তারা আশঙ্কা করছেন, প্রজ্ঞাপনের তিন দফা শর্তের কারণে প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রায় ২০ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণের ‘স্বপ্ন’ পূরণ হবে না।
প্রজ্ঞাপনের শর্তগুলো হচ্ছেÑ বিদ্যালয়ের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কমপে ১৫০ জন শিার্থী থাকতে হবে। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫০ জন শিার্থী থাকলেও হবে। প্রতি বিদ্যালয়ে একজন প্রধান শিকসহ চারজন শিক থাকতে হবে। এর মধ্যে অর্ধেক থাকবেন নারী শিক। তবে যেসব বিদ্যালয়ে ৪০০ জনের বেশি শিার্থী রয়েছে সেখানে পাঁচজন শিক থাকতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, বিদ্যালয়টি স্কুলম্যাপিং এরিয়ার মধ্যে কি না অর্থাৎ জাতীয়করণের আওতায় আনা বিদ্যালয়টির আশপাশের এক বা দুই কিলোমিটারের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে কি না। থেকে থাকলে এটি জাতীয়করণ হবে কি না তার ব্যাপারে সুপারিশ করতে হবে। তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, জাতীয়করণের ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত বিদ্যালয়টিতে কর্মরত শিক্ষকদের শিক্ষকতার কাক্সিত যোগ্যতা রয়েছে কি না।তবে এ ক্ষেত্রে একটি সুযোগ দেয়া হয়েছে, সরকারি শিক্ষক হওয়ার জন্য যোগ্যতা না থাকলে পরের তিন বছরের মধ্যেই সে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
এ তিনটি শর্ত ছাড়াও জাতীয়করণের জন্য ১১ দফা শর্ত রয়েছে, যার মাধ্যমে স্কুলগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রজ্ঞাপনে তিন স্তরের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ তিন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের ‘স্বপ্ন পূরণ’ বা স্কুল জাতীয়করণের ‘তকমা ’ লাগবে।
এসব শর্ত প্রত্যেক বিদ্যালয় পূরণ করেছে কি না মাঠপর্যায়ে দেখার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠন করা পাঁচ সদস্যের জেলা কমিটির কাছে প্রতিবেদন দেবে। দুই কমিটি পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন দেবে প্রাথমিক ও গণশিা মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে গঠন করা ছয় সদস্যের কেন্দ্রীয় টাক্সফোর্স মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদন খতিয়ে দেখে জাতীয়করণের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রশাসনিক অনুমোদন দেবে। সব অনুমোদন শেষে আগামী মে থেকে শিকেরা প্রথম ধাপের জাতীয়করণের সুবিধা পাবেন। প্রজ্ঞাপন জারিতে হতাশ ও ুব্ধ শিক্ষকেরা যাচাই-বাছাইয়ের আগে জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়াকে শিক্ষকদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ‘নির্বাচনী ঘুষ’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এ ঘুষ ‘বদহজম’ হতে পারে বলেও কয়েকজন শিক্ষক মন্তব্য করেছেন। জাতীয়করণ আন্দোলনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক নেতারা নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে শিক্ষক নেতাদের যে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি ছিল এ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা লঙ্ঘিত হয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। এ হাতাশার শেষ পরিণতি কী হবে তাই এখন দেখার অপেক্ষা।
প্রাথমিক ও গণশিা নিয়ে কর্মরত এনজিও সংগঠন গণসারতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী ও সেনাসমর্থিত বিগত জরুরি সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটি সঠিক হলেও প্রজ্ঞাপন জারির প্রক্রিয়াটি ভুল হয়েছে।যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিল সরকার প্রধানের ঘোষণার আগে।
উল্লেখ্য, গত ৯ জানুয়ারি সারা দেশ থেকে বেসরকারি প্রাথমিক শিকদের ঢাকায় এনে মহাসমাবেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং তাদের বেতন ১ জানুয়ারি থেকেই গণনার কথা বলেছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে প্রজ্ঞাপন জারির পর যাচাই-বাছাই করতেই এপ্রিল মাস পার হয়ে যাবে।এরপর তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। অর্থাৎ কতজন শিক্ষক ও কতটি বিদ্যালয় জাতীয়করণের আওতায় আসবে তা নির্ধারিত হবে। এরপরই শিক্ষকদের বেতনভাতা পাওয়ার প্রশ্ন আসবে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় বলা হয়েছে, তিন ধাপে দেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এসব বিদ্যালয়ে কর্মরত এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিকের চাকরি জাতীয়করণের আওতায় আসবে। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার এক সপ্তাহ পরই প্রাথমিক ও গণশিা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক শিকদের চাকরি জাতীয়করণের জন্য কয়েকটি শর্ত জারি করল। একই সাথে জাতীয়করণের জন্য তিন স্তরের তিনটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের জারি করা জাতীয়করণের শর্তের কারণে অনেক বিদ্যালয়ই বাদ পড়ে যাবে। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, পাঁচ হাজারের কাছাকাছি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং প্রায় ২০ হাজার শিকের চাকরিও জাতীয়করণ হবে না। এর ফলে শিকসমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বেসরকারি প্রাথমিক শিক সমিতির সভাপতি মো: আমিনুল ইসলাম চৌধুরী গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, সব স্কুলে প্রয়োজনীয় ১৫০ শিার্থী নাও পাওয়া যেতে পারে। এ অবস্থায় জাতীয়করণের শর্ত হিসেবে ১৫০ শিার্থী থাকার বাধ্যবাধকতা শুভ হবে না। এই শর্তের কারণে কমপে চার-পাঁচ হাজার স্কুল বাদ পড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, নতুন করে যাতে এসব শর্ত না দেয়া হয় সে জন্য সমিতির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করা হয়েছিল।
প্রায় দুই যুগের আন্দোলনের পর বর্তমান সরকার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়। ঘোষণা অনুযায়ী ২২ হাজার ৯৮১টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯১ হাজার ২৪ জন শিক চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকেই জাতীয়করণের সুবিধা পাবেন। আর স্থায়ী-অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত, কমিউনিটি এবং সরকারি অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দুই হাজার ২৫২টি বিদ্যালয়ের নয় হাজার ২৫ জন শিককে আগামী ১ জুলাই থেকে এবং পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত এবং পাঠদানের অনুমতির অপোয় থাকা ৯৬০টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার ৭৯৬ জন শিককে তৃতীয় ধাপে আগামী বছর ১ জানুয়ারি জাতীয়করণের সুবিধা দেয়া হবে।
নিউজরুম