ঢাকা (২০জানুয়ারী) : কোনো যুক্তি বা কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই পদ্মাসেতু প্রকল্পের দুর্নীতির ঘটনার সঙ্গে যে কোনোভাবে তাকে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এমপি।
গত ১৫ জানুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানকে লেখা বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যান লুই মোরেনো ওকাম্পোর চিঠির বক্তব্যের বিষয়ে রোববার এক বিবৃতিতে এ অভিযোগ করেন তিনি।
সৈয়দ আবুল হোসেন তার বিবৃতিতে দাবি করেন, ‘‘পত্রিকায় প্রকাশিত প্যানেল চেয়ারম্যানের চিঠির (চিঠি যদি সত্য হয়) প্রতিটি বক্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মন্ত্রী হিসেবে শুধুমাত্র আমার নামটি অভিযোগে অন্তর্ভুক্ত করলেই পদ্মাসেতুর নির্মাণের সকল অন্তরায় দূর হবে। কোনো যুক্তি নয়, কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নয়, ঘটনার সঙ্গে যে কোনোভাবে আমাকে যুক্ত করতে হবে। তাহলে বিশ্বব্যাংক খুশি হবে। আর বিশ্বব্যাংক খুশি হলেই পদ্মাসেতুর কার্যক্রম শুরু করা যাবে।’’
প্যানেল চেয়ারম্যানের এ ধরনের মনোভাব একটি আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দলের পক্ষে কোনোভাবেই যৌক্তিক নয় এবং তার চিঠির বক্তব্যকে অসার ও উদ্দেশ্যমূলক বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এ মন্ত্রী।
আবুল হোসেন তার বিবৃতিতে বলেন, ‘‘মন্ত্রী হিসেবে আমার নামে প্যানেলের অভিযোগ ৫টি। প্রথমতঃ এসএনসি-লাভালিনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমি দেখা করেছি। দ্বিতীয়তঃ এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি প্রেরিত ই-মেইলে সচিবের বরাত দিয়ে ‘বড় কর্মকর্তা’র ইচ্ছে সংক্রান্ত বিষয়বস্তু সংযুক্ত থাকা। তৃতীয়তঃ রমেশ শাহের ডায়েরিতে ‘পিসিসি কস্ট’ হিসেবে লেখা আমার নাম ও পার্সেন্টেজের পরিমাণ সংযুক্ত থাকা। চতুর্থতঃ পরামর্শক নিয়োগে খোলা দরপত্রে প্রাথমিকভাবে ২য় অবস্থান থেকে এসএনসি-লাভালিন প্রথম অবস্থানে উঠে আসা। পঞ্চমতঃ মন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদনকারী বলে সকল দায়িত্ব মন্ত্রীর ওপর বর্তায়।’’
‘‘কয়েকটি পৃথক পৃথক অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনাকে একীভূত করে কল্পনাপ্রসূত ও মনগড়া একটি অভিযোগ উত্থাপন করে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যানের আমাকে জড়িত করার বিষয়টি বোধগম্য নয়। প্যানেল চেয়ারম্যানের চিঠির বক্তব্য যে অসার ও উদ্দেশ্যমূলক তা সহজেই বোঝা যায়।’’
সৈয়দ আবুল হোসেনের দাবি, ‘‘প্যানেল চেয়ারম্যানের আমার সম্পর্কে উত্থাপিত অভিযোগের সঙ্গে ঘটনা প্রবাহের কোনো যোগসূত্র নেই, সত্যতা নেই। কোনো অন্যায় ও দুর্নীতি না করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বিশ্বব্যাংকের সন্তুষ্টির জন্য আমার অর্জিত মান-সম্মান বিনষ্ট করে দুর্নীতির মামলায় জড়িত করে আমার নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা- কোনো সতেচতন ও বিবেকবান মানুষের কাম্য হতে পারে না।’’
এসব অভিযোগের বিষয়ে আবুল হোসেনের ব্যাখ্যা হচ্ছে, ‘‘প্রথমতঃ আমি এসএনসি-লাভালিনের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বা গোপনীয়ভাবে কখনো দেখা করিনি। শুধুমাত্র সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর অনুরোধে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেতু বিভাগের সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সৌজন্যমূলক কথা বলেছি।’’
‘‘এসএসনসি-লাভালিন ছাড়ও এ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রদূতসহ অনেকের সঙ্গে আমার অফিস কক্ষে সাক্ষাত হয়েছে- যা আমার দাফতরিক কাজেরই একটি অংশ ছিল।’’
‘‘বাংলদেশের মন্ত্রী/সচিবদের এরকম সাক্ষাত দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধি-বিধান থাকার কথা আমার জানা নেই।’’
বিবৃতিতে আবুল হোসেন প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘‘দ্বিতীয়তঃ স্থানীয় প্রতিনিধির এসএনসি-লাভালিনের সদর দফতরে পাঠানো ই-মেইলের বিষয়বস্তুতে যদি আমার নামে কিছু উল্লেখ থাকে- তাতে কি প্রমাণিত হয় যে, এ ঘটনার সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত? সংশ্লিষ্ট সকলের কাছ থেকে প্রকৃত সত্য উদঘাটন না করে এ বিষয়ে আমাকে জড়িত করা- ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গেও তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’’
‘‘তৃতীয়তঃ রমেশ শাহের ডায়েরিতে লেখা ‘পিসিসি কস্ট’ যার কোনো অনুলিপি এখনো পাওয়া যায়নি। যার ডায়েরিতে ‘পিসিসি কস্ট’ হিসেবে আমার নামে পার্সেন্টেজের কথা লেখা আছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার বক্তব্য গ্রহণ ছাড়াই আমাকে পার্সেন্টেজ প্রদানের বিষয়টি সঠিক ও সত্য হিসেবে ধরে নেওয়া আমার প্রতি অবিচার করার নামান্তর মাত্র এবং আইনের দৃষ্টিতে তা গ্রহণযোগ্যও নয়। এক্ষেত্রে, কথিত ডায়েরির কপি, রমেশ শাহের বক্তব্য, পার্সেন্টেজের প্রস্তাবকারীর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা- তা পরীক্ষাসহ পারিপার্শ্বিক অন্যান্য বিষয়াবলী অনুসন্ধান করে প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করা হলে এ ব্যাপারে আমাকে দায়ী করার কোনো উপাদান পাওয়া যাবে না বলে আমি নিশ্চিত।’’
তিনি বলেন, চতুর্থতঃ এসএনসি-লাভালিনের দ্বিতীয় থেকে প্রথমে উঠে আসার সম্পর্কে আমার যতোটুকু মনে পড়ে, বিশেষজ্ঞ কমিটির কারিগরি মূল্যায়ন রিপোর্ট বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হলে বিশ্বব্যাংক তাতে অনুমোদন না দিয়ে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা দেয়।
বিশেষজ্ঞ কমিটি বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী মূল্যায়ন রিপোর্ট সংশোধন এবং চূড়ান্ত করে। বিশেষজ্ঞ কমিটির মূল্যায়নে দেখা যায়, চূড়ান্ত মূল্যায়নে এসএনসি-লাভালিন প্রথম হয়। বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন কমিটি যে প্রস্তাব দিয়েছে তাই হুবহু বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। তাতে মন্ত্রী হিসেবে আমি কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা সংশোধন করিনি। এসএনসি-লাভালিনের দ্বিতীয় অবস্থান থেকে প্রথমে উঠে আসার ক্ষেত্রে আমার কোনো ভূমিকাই ছিল না। এ ক্ষেত্রে কোনো সম্পৃক্ততা থাকলে তা ছিল বিশ্বব্যাংক ও টিইসি কমিটির- এটা যে কোনো সাধারণ মানুষের কাছেও বোধগম্য।’’
বিবৃতিতে আবুল হোসেন আরও দাবি করেন, ‘‘পঞ্চমতঃ প্যানেলের ধারণা মোতাবেক মন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদনকারী- এ কথা ঠিক নয়। ক্রয়নীতি অনুযায়ী যে কোনো প্রকল্পের উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তি মূল্য সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তি মূল্য সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অনুমোদন দিতে পারেন। চুক্তি মূল্য এর বেশি হলে তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীর সুপারিশসহ সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত্র মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন করতে হয় এবং সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ গ্রহনযোগ্য হলে তা চুক্তি সম্পাদনের জন্য অনুমোদন দেয়। পদ্মাসেতুর পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে যার আনুমানিক চুক্তি মূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। তাই এ চুক্তি অনুমোদনের ক্ষেত্রে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কোনোভাবেই সর্বোচ্চ অনুমোদন দাতা নন। কাজেই ‘মন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদনকারী’- এ মতামত ঠিক নয়।’’
‘‘পরামর্শক নিয়োগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আমার সম্মতি প্রয়োজন ছিল- নিরপেক্ষ প্যানেলের এ ধারণাও কোনোমতেই সঠিক নয়। মূলতঃ পদ্মাসেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ টিইসি কমিটির মূল্যায়ন, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অনুমোদনের ভিত্তিতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপিত হয়। অতঃপর চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের পরই যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়।’’
‘‘এক্ষেত্রে প্যানেলের ধারণা অনুযায়ী মন্ত্রী হিসেবে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দর-কষাকষি করে কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের আদৌ কোনো এখতিয়ার আমার ছিল না। প্যানেলের ভাষ্য অনুযায়ী কারো সঙ্গে আমার দরকষাকষির প্রশ্ন অবান্তর। মন্ত্রী হিসেবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পরামর্শক নিয়োগে আমার ভূমিকা ছিল মূলতঃ গৌণ।’’
‘‘দুদক তদন্তে এ পর্যন্ত আমার কোনো সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায়নি। প্রাথমিক তদন্তের জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ায় আমি বলেছি, পদ্মা সেতু নির্মাণের কোনো অংশে আমার কোনো নেতিবাচক সম্পৃক্ততা নেই। আমি পদ্মাসেতু নির্মাণে দ্রুততর কাজ করেছি। অল্প সময়ের মধ্যে সকল আনুষ্ঠানিক কাজ সমাপ্ত করে এনেছি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ মোতাবেক বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের অনুমোদন অতিক্রম করে দরপত্র মূল্যায়ন চুড়ান্ত পর্যায়ে অগ্রসর হয়েছে।
এক্ষেত্রে মন্ত্রী হিসেবে সুপারিশ বাস্তবায়ন করা ছাড়া আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। আমি মূল্যায়ন কমিটির কোনো সদস্যের কাছে কোনো প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কোনো তদবির করিনি। আমি তদবির করেছি- এ কথা মূল্যায়ন কমিটির কোনো সদস্য বলেননি, বলতেও পারবেন না।’’সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন যে, বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট সবাই প্রকৃত সত্য উপলদ্ধি ও ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে পরবর্তী ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন।
নিউজরুম