টঙ্গী (২০জানুয়ারী) : আখেরি মোনাজাতে দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো বিশ্ব ইজতেমার ২য় পর্বের। একইভাবে শেষ হলো এবারের ৪৭তম বিশ্ব ইজতেমার সকল আনুষ্ঠানিকতা। বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে মোনাজাত শুরু হয়। শেষ হয় ১টা ২ মিনিটে।
২২ মিনিট স্থায়ী এই মোনাজাতে দুহাত ঊর্ধ্বমুখী করে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেওয়া কয়েক লাখ মুসল্লি বারবার বলছিলেন, আমিন আমিন। মোনাজাতের সময় এই ধ্বনিতে পুরো টঙ্গী এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। তারা সবাই ইহলোকের মঙ্গল ও পরলোকের ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। চাইলেন সুখ ও সমৃদ্ধি।
মোনাজাত পরিচালনা করেন ভারতের মাওলানা জোবায়েরুল হাসান। তিনি দোয়া করলেন বিশ্ব মুসলিমের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্যও দোয়া করা হলো। বিশ্ব জমায়েতের ২য় শেষ পর্ব শুরু হয় ১৮ জানুয়ারি। প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিল ১৩ জানুয়ারি। ১৫ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় অর্ধ লক্ষ বিদেশি মেহমানসহ কয়েক লাখ মানুষ এই আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। কয়েকটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি মোনাজাত সম্প্রচারের ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে মোনাজাতে শরিক হতে পেরেছেন।
মোনাজাত উপলক্ষে ইজতেমাস্থল টঙ্গী শহর ও এর আশপাশের এলাকা যেনো জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রোববার সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ইজতেমা মাঠের দিকে যেনো ঢল নেমেছিল টুপি-পাঞ্জাবি পরিহিত লাখ লাখ মানুষের। তুরাগ তীরের চারপাশে যেদিকে চোখ যায়—সেদিকেই দেখা যাচ্ছিল শুধু সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি পরা মানুষের ভিড়।এ যেনো এক অন্যরকম দৃশ্য।
হেদায়াতি বয়ান
রোববার বাদ ফজর বাংলাদেশের মাওলানা রবিউল হকের বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া মোনাজাতের আগে চলে হেদায়াতি বয়ান। বয়ানে তিনি বলেন, আল্লাহর গজবের বড় স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। তিনি আল্লাহর রাস্তায় (তাবলিগে) দাওয়াতি কাজে পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ পায়ে হেঁটে বেশি মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া সম্ভব হবে। এতে পায়ে যে ধূলাবালি লাগবে তা জাহান্নামের আগুনকে ঠাণ্ডা করে দেয়।
তিনি তাবলিগের দাওয়াতি কাজে গিয়ে মানুষের কাছে ইহজগতের জন্য ছওয়াল করতে বারণ করে বলেন, যে জামাত ছওয়াল করে আল্লাহর সাহায্যের দরজা তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ছওয়াল করলে দিলে শয়তান স্থান পায়। দাওয়াতি কাজে সবচেয়ে বড় কাজ হলো নিজের নিয়তকে সহি করা এবং অন্যের কাছে ছওয়াল না করা।
বয়ান
এদিকে লাখো মুসলি্লর জিকির-আসকার ও তবলিগ মুরবি্বদের গুরুত্বপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে শনিবার বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। ইজতেমায় তবলিগের শীর্ষ মুরবি্বরা বাদ ফজর, বাদ জোহর, বাদ আসর ও বাদ মাগরিব আমবয়ান (সর্বজনীন বয়ান) করেন।
তবলিগ মুরবি্বরা বয়ান ও নামাজের মিম্বর থেকে আলেম, শিক্ষিত, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজের ছাত্র এবং বিদেশি মুসল্লিদের উদ্দেশে খুসুসি বা খাসবয়ানও (নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য বয়ান) করেছেন। ফজরের পর পাকিস্তানের মাওলানা জামিল, জোহরের পর ভারতের মিয়াজি আজমত উল্লাহ, আসরের পর ভারতের মাওলানা যোবায়েরুল হাসান এবং মাগরিবের পর ভারতের মাওলানা আহমদ লাট আমবয়ান করেন।
বিদেশি মুসল্লি
বিদেশি মুসল্লিদের ইজতেকবাল (অভ্যর্থনা) কক্ষ সূত্রে জানা গেছে, শনিবার পর্যন্ত বিশ্বের ৮৭টি দেশের প্রায় ১৫ হাজার মুসল্লি ইজতেমায় শরিক হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬৬ জন বিভিন্ন মেয়াদের চিল্লাধারী মুসল্লি এবং বাকি ২ হাজার ৯৮০ জন শুধু ইজতেমায় অংশ নিয়ে আখেরি মোনাজাত শেষে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবেন। এ বছর পাকিস্তান থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক, অর্থাৎ ৭৬৯ জন মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন।
রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লি অসুস্থ
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের শেষ ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের কন্ট্রোল রুমের স্বাস্থ্য পরিদর্শক এ কে এম ফজলুর রশিদ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমকে জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ৪ হাজার ২’শ ৮৫ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আশংকাজনক অবস্থায় ২১ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই নিয়ে বিশ্ব ইজতেমার ২টি পর্বে প্রায় ৫ সহস্রাধিক মুসল্লি অসুস্থ হয়েছেন।
বিশেষ করে ইজতেমা চলাকালীন সময়ে প্রচণ্ড শীত, শৈত্য প্রবাহে ইজতেমার পুরো সময়টিই ছিল কনকনে শীতের আমেজে। এর পরও মুসল্লিদের ইজতেমায় অংশগ্রহণ কমে নি।
চিকিৎসা; বিশ্ব ইজতেমার দুই পর্বে রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লি অসুস্থ হয়েছেন। বিশ্ব ইজতেমার স্বাস্থ্য বিভাগের কন্ট্রোলরুমের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা সাকির হোসেন জানান, দুই পর্বে ৩২হাজার ২৫৫ জন অসুস্থ মুসল্লিকে সরকারি ভাবে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে।
মোবাইল ফোনে মোনাজাত
ইজতেমা স্থলে যেতে পরিবহন সংকট ও ভিড় এড়াতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লোকজন মোবাইল ফোনে মোনাজাতে অংশ নেয় বলে জানা গেছে। ইজতেমার মূল মাঠ থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর সদরের চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাহ ময়দানে কয়েক হাজার মুসুল্লি জমায়েত হন। পরে তারা মোবাইল ফোন ও পুলিশের ওয়াকিটকির মাধ্যমে ইজতেমা স্থলে যোগাযোগ রক্ষা করে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হন। একই ভাবে জেলার ভোগড়া, বাসন সড়ক ও শিমুলতলী এলাকায় মোবাইল মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
মোনাজাত শেষে জট
আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়া মানুষ একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। মুসুল্লিরা শুরু করে দেয় হুড়োহুড়ি এবং আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এতে টঙ্গীর আশে-পাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় জনজট ও যানজট। ফলে আবারো পায়ে হেঁটে রওনা দেয় মুসল্লিরা। আর পাঁয়ে হাঁটা মুসুল্লিদের চাপে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসুল্লিদের যানবাহন আটকা পড়ে যায়।
বিদায় বিশ্ব ইজতেমা
মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পবিত্র হজ্জ্ব পালনের পর দ্বিতীয় আয়োজন বিশ্ব ইজতেমা। জানা যায়, ১৯৪৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার কাকরাইল মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব ইজতেমার নামাজ। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তে ১৯৪৮ সালে এই ইজতেমাকে চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। এর ৯ বছর পর নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। এরপর ১৯৬৬ সাল থেকে গাজীপুর জেলার টঙ্গী পৌর এলাকাধীন ঐতিহাসিক তুরাগ তীরে ১৬০ একর জমির ওপর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা।
২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে বিভক্ত হয়ে এই ইজতেমা হচ্ছে। প্রথম পর্ব ১৩,১৪ ও ১৫ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব ২০, ২১ ও ২২ জানুয়ারি ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। দুই পর্বে ১৫ ও ২২ জানুয়ারি দুটি আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। দুটি মোনাজাতই পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলীগ জামাতের মুরুব্বি দিল্লীর মাওলানা জোবায়ারুল হাসান।
২০১২ সালের দুই পর্বের ইজতেমায় সবমিলে দুই শতাধিক যৌতুক বিহীন বিয়ে হয়। প্রথম পর্বে ১০৪ টি ও দ্বিতীয় পর্বে ১০৩ টি বিয়ে হয়। ২০১২ সালের ইজতেমায় প্রায় ১’শটি দেশের ২০ হাজারেরও অধিক বিদেশি মেহমান অংশ নেয়।
২০১৩ সালের দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় মিসর, ওমান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, কাতার, অস্ট্রেলিয়া, ব্রনাই, কানাডা, কম্বোডিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, ইরান, জাপান, মাদাগাস্কার, মালি, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, পানামা, সেনাগাল, দঃ আফ্রিকা, তানজানিয়া, ত্রিনিদাদ, রাশিয়া, আমেরিকা, জিম্বাবুয়ে, বেলজিয়াম, চীন, কমোরেস, ফিজি, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, কেনিয়া, মালয়শিয়া, মায়ানমার, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, থাইল্যান্ড, তার্কি, যুক্তরাজ্য, জাম্বিয়া, কোরিয়া, আলজিরিয়া, ডিজিবুতি, ইথিওপিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, কুয়েত, মরক্কো, কাতার, সোমালিয়া, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তান, বাহরাইন, ইরিত্রিয়া, জর্দান, মৌরিতানিয়া, ভারত, সুদান, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশের মুসল্লিরা অংশ নেয়।
মুসল্লির মৃত্যু
৬০ বছরের রেকর্ড ভাঙা শীতের মধ্যে ইজতেমা শেষ হলেও ২০১৩ সালের দুই পর্বে ২১ জন মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে মারা গেছেন। দ্বিতীয় পর্বে এ পর্যন্ত ৮জন মুসল্লির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সর্বশেষ যারা মারা গেছেন তারা হলেন, নঁওগা জেলার মান্দা থানার নাপিত পাড়া গ্রামের ইসমাইল হোসেন(৬৫), খুলনা জেলার খালিশপুর থানার মুজগুন্নি গ্রামের হেদায়েতুল ইসলাম(৭০) ও বি.বাড়িয়া জেলা সদরের কাজিপাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন(৫৬)।
যৌতুক বিহীন বিয়ে
শনিবার আসরের নামাজের পর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের মূল মঞ্চে ৩৫টি যৌতুক বিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নিয়ে দুই পর্বে যৌতুক বিহীন বিয়ে হলো ১৭৭টি। সকাল থেকেই অভিভাবকেরা হবু দম্পতিদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। বিয়ের পর বয়ান মঞ্চ থেকেই মোনাজাতের মাধ্যমে নব দম্পতিদের সুখ-সমৃদ্ধিময় জীবন কামনা করা হয়।বাদ আসর মাওলানা জোবায়েরুল হাসান ওই যৌতুকবিহীন বিয়ে পড়ান।
আটক-জরিমানা
টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) ইসমাইল হোসেন এবারের বিশ্ব ইজতেমায় মোট ৪৩ জন কে বিভিন্ন অপরাধে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। এছাড়া ১২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই পর্বে ৩ লাখের বেশী টাকা জরিমানা করে ৬২টি মামলা দায়ের করেছেন। এছাড়া চিকিৎসার নামে প্রতারণা ও তথাকথিত ঔষুধ বিক্রির অভিযোগে র্যাব কর্তৃক আটক ৩৯জন অপচিকিৎসককে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন।
এ বারে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে সরকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর মধ্যে বিভিন্ন ভাবে প্রায় ১২ হাজারের মত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। রাত ২টা পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ভোগড়া বাইপাস থেকে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়।
নাওজোর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট ইকবাল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, ভোররাত ২টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে শনিবার বিকেল থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে ময়দান অভিমুখে। মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার আশঙ্কায় অন্ধকার থাকতেই তীব্র শীত উপেক্ষা করে মুসল্লিরা ময়দান অভিমুখে যাত্রা করে। তারা ব্যাক্তিগত পরিবহন, বাস, রিক্সা, অটোরিক্সা যোগে অথবা পায়ে হেঁটে ময়দানের এসে পৌছে। ভোর ৫ টার দিকে ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়কের আব্দুল্লাহপুর এবং ভোগড়া পয়েন্টে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। ফলে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পেড়িয়ে মানুষ ফজরের জামাতে অংশ নেয়। এদিকে মুসল্লিরা ইবাদত, জিকির-আসকার, ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে ইজতেমা ময়দানে নির্ঘূম রাত কাটিয়েছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
আইন শৃঙ্খল বাহিনীর পক্ষে টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন বাংলানিউজকে বলেছেন, দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এবারও ইজতেমার আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ১২ সহস্রাধিক সদস্য নিয়োজিত ছিল। ইজতেমা মাঠে মুসল্লিদের সুবিধার্থে প্রথম পর্বের নেওয়া সব ধরনের প্রস্তুতি বহাল ছিল। পর্বের মতই ৬০ টি সি সি টিভি ক্যামেরা, ৯টি ওয়াচ টাওয়ার ও মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিমুহূর্তের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রাশেদুল আলম জানান, দ্বিতীয় দফায়ও র্যাব সদস্যরা ৪টি সেক্টরে ভাগ হয়ে ইজতেমার ময়দান ও আশপাশে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকছে বেশ কিছু সিসিটিভি, নয়টি ওয়াচ টাওয়ার, নৌ-টহল, চেকপোস্ট ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম।
নিয়ন্ত্রিত যান
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ জানায়, সুষ্ঠুভাবে আখেরি মোনাজাত সম্পন্ন করতে রোববার বিশ্বরোড-প্রগতি সরণি এলাকা থেকেই যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে কলেজগেট থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য সড়কেও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
তবে মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে আন্তঃনগরসহ সব ধরনের ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে থামছে। ইজতেমা ময়দানের আশপাশের এলাকা থেকে বিআরটিসির অতিরিক্ত বাস চলাচল করছে।
পুরো ময়দানে ৩৮ খিত্তা
বিশ্ব ইজতেমার মুসল্লিদের সুশৃঙ্খল অবস্থানের জন্য প্রথম পর্বে তৈরিকৃত ইজতেমা ময়দানে চটের তৈরি পুরো প্যান্ডেলকে খিত্তায় ভাগ করে বিভিন্ন জেলাওয়ারি মুসল্লিদের অবস্থানের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় পর্বে ৩৩ টি জেলার মুসল্লিদের জন্য ৩৮টি খিত্তা করা হয়।
এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা ১ ও ২নং খিত্তায়, ঢাকা ৩, ৪, কঙবাজার, মানিকগঞ্জ ৬, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ৮, টাঙ্গাইল ৯, জামালপুর ১০, বরিশাল ১১, নেত্রকোনা ১২, কুমিল্লা ১৩, মেহেরপুর ১৪, ঝিনাইদহ ১৫, ময়মনসিংহ ১৬, ১৭ ও ১৮, লক্ষ্মীপুর ১৯, বি-বাড়ীয়া ২০, কুড়িগ্রাম ২১, নোয়াখালী ২২, নীলফামারী ২৩, ঠাকুরগাঁও ২৪, পঞ্চগড় ২৫, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২৬, বগুড়া ২৭, পাবনা ২৮, নওগাঁ ২৯, মুন্সিগঞ্জ ৩০, ৩১, মাদারীপুর ৩২, গোপালগঞ্জ ৩৩, সাতক্ষীরা ৩৪, মাগুরা ৩৫, খুলনা ৩৬, সুনামগঞ্জ ৩৭, মৌলভীবাজারের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ৩৮নং খিত্তায় অবস্থান নিয়ে বয়ান শোনেন।
১ম দফায় পুরো ইজতেমা মাঠকে ৪৪ খিত্তায় ভাগ করা হয়েছিল, যাতে ৩৩ জেলার মুসল্লিরা অবস্থান নিয়েছিলেন। তবে ঢাকা জেলার মুসল্লি বেশি থাকায় এ দফাও তারা ইজতেমায় অংশ নিয়েছে বলে জানিয়েছে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ।
গাড়ি পার্কিং
১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব উপলক্ষে মুসল্লিদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে যানবাহন চলাচল ও পার্কিং নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
পুনর্বিন্যস্থ সূচি অনুয়ায়ী ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২০ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ধউড় সেতু থেকে আব্দুল্লাহপুর হয়ে প্রগতি সরণি এবং টঙ্গী সেতু থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বিমানযাত্রী, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া সব যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।
ঘোড়াশাল থেকে পুবাইল-কালীগঞ্জ হয়ে আসা যানবাহন টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বে মরকুন (কে-২) পর্যন্ত চলাচল করতে পারবে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক থেকে ঘোড়াশাল হয়ে ঢাকাগামী যানবাহন কাচপুর/যাত্রাবাড়ী সড়ক ব্যবহার করবে।
বিভিন্ন এলাকার যানবাহনের জন্য পৃথক স্থান পার্কিং এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। ঢাকা মহানগরীর গাড়ির জন্য নিকুঞ্জ-১ আবাসিক এলাকার খালি জায়গা, উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর ও রাজউক কলেজের আশেপাশের খালি জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
সিলেট বিভাগের গাড়ি উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর, বরিশাল বিভাগ ধউড় সেতু ক্রসিং সংলগ্ন এলাকা, ঢাকা বিভাগ সোনারগাঁও সড়ক ও জনপথ সড়কের পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত, খুলনা বিভাগ উত্তরা ১০ ও ১১ নম্বর সেক্টর সড়কের দুপাশে, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ হাউজিং মাঠ, চট্টগ্রাম বিভাগ উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের গাউছুল আজম ও গরীবে নেওয়াজ রোডের দুপাশে এবং বরিশাল ও খুলনা বিভাগ উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরের খালি জায়গায়, রাজশাহী বিভাগের গাড়ি কামারপাড়া হাউজিং মাঠ ও ১০ নম্বর সেক্টরের খালি জায়গায় পার্কিং করবে।
কয়েক হাজার পরিত্যক্ত জুতা
আখেরি মোনাজাত শেষে হুড়োহুড়ি করে বের হতে গিয়ে কয়েক হাজার জুতা-স্যান্ডেল ফেলেই মাঠ ত্যাগ করেন মুসল্লিরা। মোনাজাত শেষে আশে-পাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে কয়েক হাজার জুতা-স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আর টোকাইদের বস্তায় ভরে ওইসব জুতা-স্যান্ডেল নিয়ে যেতে দেখা যায়।
এর আগে গত রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের। মোনাজাতে বিশ্ব মুসলিমের শান্তি কামনা করা হয়। রোববার বেলা ১২টা ৫৬ মিনিটে মুনাজাত শুরু হয়। শেষ হয় ১টা ২২ মিনিটে।
২৪ মিনিট স্থায়ী এই মোনাজাতে দুহাত ঊর্ধ্বমুখী করে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেওয়া কয়েক লাখ মুসল্লি বারবার বলছিলেন, আমিন আমিন। মোনাজাতের সময় এই ধ্বনিতে পুরো টঙ্গী এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে।
বিশ্বের ১০৭টি দেশের প্রায় ৪২ হাজার বিদেশি মেহমানসহ প্রায় কয়েক লাখ মানুষ এতে অংশ নেন। কয়েকটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি মোনাজাত সম্প্রচারের ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে মোনাজাতে শরিক হতে পেরেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও বিদেশি মিশনের কর্মকতার্, বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদের সদস্য বর্গসহ বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ মোনাজাতে শরিক হন। আর এর ৪দিন বিরতিতে শুরু হয়েছিল ২য় পর্ব।