(১৬ জানুয়ারী): বাঘে ছুঁলে কত ঘা, তার একটা হিসাব আছে। পুলিশে ছুঁলে কত ঘা, তাও হয়তো অনুমান করা যায়। কিন্তু সজনী ছুঁলে জখম কতটা গভীর হবে, আগাম অনুমান করা সম্ভব নয়। সজনী একবার দাঁত বসালে তাঁর আমলের বাঘা সাহিত্যিকেরাও তাঁদের অঙ্গ থেকে রক্ত ঝরতে দেখেছেন। সেই রক্তক্ষরণ আর যে শেষ হয় না। অশেষ যন্ত্রণা নিয়ে বলতে হচ্ছে, সজনীটা এমনই।
খ্যাতিমান লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্র কলকাতার কাছেই উপন্যাসটির জন্য ‘আকাদামি’ পুরস্কার পেয়েছেন।সর্বভারতীয় কর্তৃপক্ষের এই বিবেচনায় বাঙালি পাঠক অবশ্যই খুশি হয়েছেন।এমনকি সজনীকান্ত দাসও ‘অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন’। সজনীর আনন্দ কিংবা বেদনায় কী এসে যায়—এ কথা বলে যাঁরা তাঁকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, ঘাট মানতে হয়েছে তাঁদেরও। গজেনবাবুর এই প্রাপ্তিযোগে সজনীর আনন্দের নমুনা:
‘তবে তিনি (গজেন্দ্রকুমার মিত্র) যদি মনে করেন, রচনার উৎকর্ষ বিচারে তিনি পুরস্কৃত হইয়াছেন, তাহা হইলে ভুল করিবেন। দিল্লির মা সরস্বতী প্রেমেন কাত বা গজেন মাত হইবার মতো সাহিত্যবুদ্ধিসম্পন্না নহেন। হইলে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ প্রভৃতি গজেন্দ্রকুমারের অগ্রণী হইতেন। গজেন্দ্র বিজয়ী হয়েছেন নাম-মাহাত্ম্যে।’
গজেনবাবুর অপরাধ বনফুল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ প্রমুখ জ্যেষ্ঠকে ডিঙিয়েছেন এবং তা ঘটেছে কলকাতার কাছেই উপন্যাসটির কল্যাণে। সুতরাং সজনীর আড়ে তাঁর প্রাপ্য হয়ে গেল। ‘নিরপেক্ষ’ একটি উপসংহার তিনি টানলেন:
‘গজেন্দ্রের গ্রন্থখানিতে “কল্কা তারকা ছেই” (অর্থাৎThe book deals with machines and wires—কল ও তার বিষয়ক গ্রন্থ) ধরিয়া লইয়াই বিচারকেরা রায় দিয়াছেন।বনফুলের জলতরঙ্গ সাবমিটেড হইলে “জলতা রঙ” (The paint is burning—রঙ জ্বলছে) এই নাম-মাহাত্ম্যে গজেন্দ্রের বইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে পারিত।’
‘গুরুত্বপূর্ণ’ ও ‘বিশ্লেষণধর্মী’ এই সাহিত্য সংবাদ শনিবারের চিঠির অগ্রহায়ণ ১৩৬৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। আকাদেমি কব্জা করায় প্রেমেন মিত্রেরও ভোগান্তি কম হয়নি।
‘চরম পাপিষ্ঠ’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত গুরুদেব শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নারীসঙ্গ বাসনা নিয়ে কী কুৎসিত প্রবন্ধই না রচনা করেছেন।
‘সুধীন্দ্রনাথের মতে, রবীন্দ্রনাথ আর তাঁহার বৌঠান বেপরোয়াভাবে পরস্পরের প্রেমে পড়িয়াছিলেন। কেলেঙ্কারি ঢাকিবার জন্য অভিভাবকগণ রবীন্দ্রনাথের বিবাহের ব্যবস্থা করেন, কিন্তু অবস্থা ক্রমশই খারাপ হইতে লাগিল, অবশেষে রবীন্দ্রনাথের বৌঠান আত্মহত্যা করেন।… কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যাকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জড়াইয়া সেই যুগে মহর্ষি পরিবারের শত্রুগণ যে কুৎসা রটনা করিয়াছিলেন, তাহারই পূর্ণাহুতি দিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কবির শতবার্ষিক মহোৎসবে।’
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ইংরেজি রচনাটি ত্রৈমাসিক কোয়েস্ট পত্রিকায় প্রকাশের পর তিনি আর দীর্ঘায়ু হননি। মৃতের সঙ্গে শোভন আচরণই কাম্য—এই আপ্তবাক্যটি আত্মস্থ করেই শনিবারের চিঠির জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৮ সংখ্যায় সজনীকান্ত কলম ধরলেন:
‘কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লোকান্তরিত হইয়াছেন। মৃতের সঙ্গে কোন্দল করা অশোভন। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ মৃত্যুর পূর্বে এমন একটি অপকর্ম করিয়া গিয়াছেন, যাহার প্রতিবাদ না করিলে আমরা কোনো দিনই নিজেদের ক্ষমা করিতে পারিব না…।’
বুদ্ধদেব বসু শনিবারের চিঠির গুরুত্বপূর্ণ এক টার্গেট। সজনীকান্ত দাস তাঁকে বাগে পেয়ে গেলেন। লিখলেন:
‘বুদ্ধদেববাবু পৌষের কালান্তে একটা “ছেলেমানুষী” করিয়াছেন। গল্পচ্ছলে একটা স্বীকারোক্তি করিয়া ফেলিয়াছেন। তিনি লিখিতেছেন—
“যে সব লোক ষোল বছর বয়েস হওয়ামাত্রই শাড়ির আঁচলের পেছনে ছুটে ছুটে হয়রান হয়ে পড়ে, সত্যি কথা বলেত কি আমি নিজেও সেই শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত।”’
Twelve বুদ্ধদেববাবু চার বছর চুরি করিলেন কেন?
বুদ্ধদেব বসুর প্রতিভা (এ প্রতিভা মেধাজাত নয়, সুন্দরী স্ত্রী প্রতিভা বসু) নিয়ে সজনীকান্তের বিদ্রূপ ছিল সার্বক্ষণিক। বুদ্ধদেব বসু প্রগতিতে লিখলেন:
‘আমাদের দেশে আজকাল নবীনদের যে সাহিত্য-প্রচেষ্টা চলছে, তার বিরুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ, গালিগালাজ ঈষৎ বিষাক্ত হুলবিশিষ্ট ভীমরুলের মতো নানা দিক থেকে ছুটে আসছে—এবং তার কেন্দ্র হচ্ছে একটি মাসিক পত্রিকা, যার নাম মুখে আনতে আমার কালো কলমও লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে।’
এবার সজনীবাবুর জবাব:
‘হায়রে, শনিবারের চিঠির উদ্দেশ্য বুঝি বৃথা যায়! কি করিতে কি হইল! আমরা ভাবিয়াছিলাম, যদি কোনও রকমে বুদ্ধদেববাবুর বদনখানি লাল করিয়া তুলিতে পারি, তাহা হইলে অন্ততঃ কিছুকালের জন্য তাহার admirer মহলে কিঞ্চিত পুলকসঞ্চার হয়। কালিমা শেষে কলমের ডগার উপর দিয়াই গেল।’
সজনীকান্ত নিশ্চয়ই এখানেই যবনিকা টানবেন না। কবিতা পত্রিকার রচনা ও রচয়িতার বাপ-বাপান্ত করেও (বিষ্ণু দে? তাঁর কবিতা নিশ্চয়ই বৈষ্ণবেরা বুঝবেন, জীবনানন্দ দাশ? সিঁড়ি দেখে যেমন কাশী চেনা যায়, ধানসিঁড়ি কিংবা নির্জন প্যাঁচা দেখে নিশ্চয়ই জীবনানন্দকে চেনা যাবে) ক্ষান্ত হননি, সজনীকান্ত রীতিমতো স্বপ্ন দেখে ফেললেন:
‘স্বপ্নে দেখিলাম, যীশুখ্রিষ্ট কলিকাতায় আসিয়াছেন, মোড়ে রসোমালাই খাইয়া এসপ্লানেডের আটচালায় মিনিট কয়েক দাঁড়াইয়া তিনি বাংলা সাপ্তাহিক, মাসিক ও ত্রৈমাসিকগুলি দেখিয়া লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া সোজা অক্টার্লনী মনুমেন্টের চূড়ায় গিয়া উঠিলেন এবং অকস্মাৎ তারস্বরে চিৎকার করিয়া গদ্য কবিতায় বলিতে লাগিলেন:
লাঞ্ছিত কর তাহাদের যাহাদের উন্মাদ প্রলাপ
তিন মাস অন্তর কবিতা হয়।
শূলে দাও তাহাদের যাহাদের অগ্রগতি
দুষ্কৃতির নামান্তর।
করুণা কর তাহাদের যাহাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার
আঘাত কর তাহাদের যাহাদের বর্তমান ঝরঝরে।
বর্জন কর তাহাদের যাহাদের বাতায়তনের অন্তরালে
বারাঙ্গনার মূর্তি।
ক্ষমা কর তাহাদের যাহাদের পূর্বাশায়
করাল ছায়া।
যিশুখ্রিষ্ট হিংস্র হইয়া উঠিয়াছেন। এ স্বপ্নের কোনো মানে নাই।’
শনিবারের চিঠির চাবুকে জর্জরিত সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলাম তো রয়েছেনই, দুচারজন রক্তাক্তও হয়েছেন। শনিবারের চিঠি প্রথম বাজারে আসে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে ১০ শ্রাবণ ১৩৩১। সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকার যোগানন্দ দাস। ২৭ সপ্তাহ শনিবারের চিঠি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। তার পর মাসিক শনিবারের চিঠি, তখন সম্পাদক নীরদ সি চৌধুরী, অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ানখ্যাত, পরে বিলেতগামী। তার পর এলেন সজনীকান্ত দাস। নীরদ চৌধুরীর সঙ্গে সজনী ছিলেন সহকারী সম্পাদক, কিন্তু দুজনের সম্পর্কটি সদ্ভাবের নয়, ল্যাং মারামারির। পরিমল গোস্বামীও পাঁচ বছর (১৯৩২-৩৭) শনিবারের চিঠি সম্পাদনা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সজনীকান্ত আর শনিবারের চিঠি সমনামিক (সিনোনিমাস) হয়ে আছে।
সজনীকান্ত স্বনামে হুল ফুটিয়েছেন, ছদ্মনামেও। ছদ্মনামা যাঁদের মধ্য দিয়ে সজনী কান্ত হুলচর্চা করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন: গাজী আব্বাস বিটকেল, ভাবকুমার প্রধান, অরসিক রায়, গোলকচন্দ্র ধাঁধা, বটুকলাল ভট্ট, কেবলরাম গাজনদার, ক্ষীণেন্দ্র ধ্রুপদ নাথ, অনুপ্রাস রঞ্জন সেন, কুড়ুল রাম, গণদাস বণিক প্রমুখ।
‘মারি ত গন্ডার লুটি ত ভান্ডার।’ শুরুটা এভাবেই। কবি জীবনানন্দ দাশ প্রগতি ও ধূপছায়াতে দুটি গন্ডারমারী কবিতা লিখেছেন। ধূপছায়ায় প্রকাশিত ১৩০ লাইনের কবিতায় ৫৭টি ‘মত’ আছে, দ্বিতীয় পৃষ্ঠার ২৪ লাইনে ১৯টি ‘মত’। প্রগতির কবিতা ২০টি।নক্ষত্রের মত, মৃত্যুর মত, যোদ্ধার মত, সেনাপতির মত, সিঙ্গুর মত, বর্ণের মত, বীণার মত, লতার মত, পাখির মত, শাখার মত, বাতাসের মত, অঙ্গারের মত…কিন্তু দুটি কবিতার একটিতে ‘হাঁদার মত’ উপমাটির যে প্রয়োগ হয়নি, সেই আফসোসই করেছেন সজনীকান্ত দাস।
বিচিত্রা পত্রিকা সম্পর্কে লেখা হচ্ছে:
‘বিচিত্রায় রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রের মৃত্যুতে শোকোচ্ছ্বাস পাঠ করিয়া আমরা বিস্মিত হই না, কারণ বিচিত্রা প্রবাসী নয়—সাহিত্যের নামে এমন কুৎসিত মোসাহেবী পেশাদার মোসাহেবদেরও কল্পনার অতীত। বিচিত্রা যে সাহিত্যিক পত্রিকার বলিয়া এখনো উল্লেখিত হয়, ইহাই বাংলা ভাষাভাষীদের পক্ষে কলঙ্কের কথা।’
বিচিত্রা এত অল্পতেই নিষ্কৃতি পেতে পারে না। সজনীকান্ত আরও যোগ করলেন:
‘বিচিত্রার সম্পাদকীয় বিভাগ “নানা কথা”। শ্রাবণের “নানা কথা”য় “দেশের কাজ ও বিশ্বভারতী” শীর্ষক প্রসঙ্গে যাহা লিখিত হইয়াছে, তাহা বাতুলের প্রলাপ বলিয়া উড়াইয়া দিলেও মনের ক্ষোভ দূর হয় না। সাহিত্য সেবার নামে পত্রিকা পরিচালনার নামে, এমন কদর্যতা স্পেনে সম্ভব, একজন কবিকে দেবতা কল্পনা করিয়া মনুষ্যত্বের যে অবমাননা ইহারা করিয়াছেন, তাহা মোহান্তদের ঘরেই সম্ভব।রবীন্দ্রনাথকে পূজা করিতে বসিয়া দেশকে এই কুৎসিত অপমান, এই জঘন্য মিথ্যাচার, দেশটা বাংলাদেশ বলিয়াই লোকে এমন অকুতোভয়ে করিতে সাহস করে।’
আবার জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার এই নিরীহ মানুষটিকে সজনীকান্তের শনিবারের চিঠি কতভাবে যে বিব্রত করেছে, তার একটি নমুনা:
‘কবি জীব না নন্দ (জীবনানন্দ নহে) দাশকে আর ঠেকাইয়া রাখা গেল না। রসের যে
ভুরীয়লোকে তিনি উত্তরোত্তর উত্তীর্ণ হইতেছেন, বুদ্ধদেব বসু অথবা সমর সেনের প্রশংসা সেখানে আর পৌঁছিবে না। জলসিঁড়ি নদীর ধারে যেখানে ধানসিঁড়ি ক্ষেত, তাহারই পাশে জামহিজলের বনে তাহার মন এতকাল পড়িয়াছিল। নাটোরের বনলতা সেন সেখান হইতে তাহাকে উদ্ধার করিয়া কাঁচাগোল্লা খাওয়াইয়া অনেকটা দুরস্ত করিয়া আনিয়াছিলেন, কিন্তু
কতক্ষণ থাকে শিলা শূন্যেতে মারিলে।
কতক্ষণ জলের তিলক রহে ভালে\
—জাল ছিঁড়িয়া তিনি আবার ভাগিয়াছেন—চিতাবাঘিনীর ঘ্রাণে ব্যাকুল ঘাই হরিণের মতো। আর তাহাকে ফিরিয়া পাওয়া যাইবে না।’
১৩৪০ থেকে ১৩৪৫ পর্যন্ত শামসুন্নাহার মাহমুদ সম্পাদিত বুলবুল শুরুতে ত্রৈমাসিক/চতুর্মাসিক ও পরে মাসিক পত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার পেছনে মানুষ হাবিবুল্লাহ্ বাহার রাজনীতিতে বেশি জড়িয়ে পড়াতেই পত্রিকাটি একসময় বন্ধ হয়ে যায়। শনিবারের চিঠিতে এই বুলবুল:
‘বুলবুল-এর সুমিষ্ট কাকলী গুল-মধুর অতি লোভে অথবা অভাবে ক্রমশ কর্কশ হইয়া উঠিতেছে; সাম্প্রদায়িকতার বন্যায় “কলস্রোতা” ক্রমেই খরস্রোতা হইতেছে। উত্তেজনার আতিশয্যে খাজা নাজিমউদ্দিন সাহেবকে উত্তেজিত করিয়া কয়েকটি সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করাইবার সাধু উদ্দেশ্য লইয়া তাঁহারা তাঁহাকে স্ত্রীলোকেরও অধম বলিয়াছেন। বুলবুল-এর কলভাষা এই—
“সৌভাগ্য বলিতে হইবে এই বেয়াড়া শিশুর (‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’-এর) বাঙ্গলার স্বরাষ্ট্রসচিব স্যার নাজিমউদ্দিন! বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত এমন কি সন্তোষকুমারীরও যদি বাঙ্গলার হোম মিনিস্টার হইতেন আঁতুড় ঘরেই এ শিশুর জীবনান্ত হইত।”’
সুখের বিষয় সম্পাদিকা বেগম শামসুন্নাহার নিজের নামোল্লেখ করিতে লজ্জাবোধ করিয়াছেন।
নতুন শিশুতোষ পত্রিকা আলোর বয়স তখনো তিন মাস হয়নি—চোখ তখনো ফোটেনি কিন্তু পাঠকের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। মীনতী ঊষারাণী মিত্র লিখলেন:
‘ইচ্ছা করে গোলাপ হয়ে
তোমার বুকে ফুটি
ইচ্ছা করে নূপুর হয়ে
চরণেতে লুটি।
মনেতে বাসনা হয়ে
বসান উড়াই
সোহাগীর মালা গেঁথে
গলেতে দোলাই।’
শনিবারের চিঠির প্রতিক্রিয়া:
“ছেলেমেয়েদের ইচ্ছা হয়তো অনেক কিছুই করে, কিন্তু যাঁহারা নিখিল বঙ্গ-শিশু-সমাজের কাছে এই সকল forbidden ইচ্ছা প্রচারের ভার লইয়াছেন তাঁহাদিগকে আর একটু সাবধান হইতে অনুরোধ করি। সন্দেশ, মৌচাক-এর মতো ইচ্ছাধীন শিশু-মাসিকের প্রচারের ফলেই যখন কলিকাতা শহরের চৌরাস্তার মোড়ে মোড়ে দুপয়সা দামের কেচ্ছা-কবিতার ছড়াছড়ি দেখিতে পাই, আলোর অতিরিক্ত বিকাশে যে কি হইবে, খোদাই জানেন।’
জীবাণু নামক একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকার শিরোনামে লেখা ছিল ‘কবিতা এক রকমের ব্যাধি, জীবাণু তার অগ্রদূত।’
শনিবারের চিঠি লেখার কাঁচামাল তাতেই পেয়ে গেল। একই সঙ্গে জীবাণু ও কবিতা পত্রিকাকে ধোলাই করল:
‘অর্থাৎ কবিতা যদি ম্যালেরিয়া-জাতীয় ব্যাধি হয়, জীবাণু তাহার অ্যানোফিলিস-মশক-বাহক; কবিতা তিন মাসে একবার প্রকাশ পায়, জীবাণুর সাক্ষাৎ পাই মাসে মাসে; জীবাণু কামড়ায় কিন্তু কবিতা ভোগায়।’
এমন অর্থ পরিপূর্ণ অত্যুক্তিহীন ‘মটো’ কদাচিৎ দেখা যায়।
বিশ্বভারতী পত্রিকা-ই বা ছাড় পাবে কেন?
‘বিশ্বভারতী পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের অক্ষমতা প্রতিদিনই প্রকট হইতেছে। সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী মহাশয় জীবনের যে মোহনায় পৌঁছিয়াছেন, সেখানে স্মৃতি বিস্মৃতি স্বভাবতই তালগোল পাকাইয়া থাকে। তিনি যে দয়া করিয়া তাহার জন্মদিন ৭ই আগস্ট তারিখটা মনে রাখিয়াছেন, ইহাই আমাদের ভাগ্য। সহকারী সম্পাদক মহাশয় ওমর খায়েম-পন্থী হইলেও এখনও দেওয়ানা হন নাই। পত্রিকাটির বিশেষ করিয়া সম্পাদক মহাশয়ের লেখা তিনি একটু দেখিয়া দিলেই পাঠকসমাজ রক্ষা পায়।
‘বিশ্বভারতীয় সহকারী সম্পাদক কান্তিচন্দ্র। আর প্রমথ চৌধুরী বারংবার বড়াই করে বলেন, “আজ ৭ই আগস্ট আমার জন্মদিন ও রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন।” অতএব শনিবারের চিঠি মন্তব্য করল, “…৭ই আগস্ট তারিখে আরও অন্তত পঁচিশ কোটি প্রাণী জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, যাহারা শত্রুর মুখে ছাই দিয়া এখনও জীবিত আছে। প্রমথ চৌধুরীর ‘আমি’র প্রসাধন ছাড়া এটি কি হিসাবে সংবাদ, তাহা আমরা বুঝিতে পারিলাম না।”’
শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত সজনীকান্ত লিখিত সংবাদ-সাহিত্যে রস ও কখনো কখনো নির্মমতারও ঘাটতি নেই। ৩৫ বছর ধরে রচিত তার সংবাদ-সাহিত্য সংকলনভুক্ত করেছেন তারই পুত্র রঞ্জন কুমার দাস। এই নিবন্ধের গৃহীত এপিসোড।সজনী-টিপ্পনীগুলো শনিবারের চিঠি: সংবাদ-সাহিত্য সংকলনভুক্ত।
বাংলাদেশের কটিয়াদী ‘অজানা ভারতীয়’ নীরদ চৌধুরীকে নিয়ে সজনী টিপ্পনী উল্লেখ করতেই হয় (স্মর্তব্য নীরদ চৌধুরী সজনীকান্তের বস ছিলেন এই পত্রিকাইে—শুরুতে নীরদ চৌধুরী তখন সম্পাদক এবং সজনীকান্ত তার সহকারী):
‘দৈত্যকুলে যেমন প্রহ্লাদ, ভারতকুলে তেমনই নীরদ সি চৌধুরী। ঠিক রাতারাতি নয়—অনেক নিশীথ রাত্রের সাধনায় তিনি ভারতবর্ষের মাটিতে ইংরেজ বনিয়া যাইতে সক্ষম হইয়াছেন। লঙ্কার বিভীষণের সঙ্গে তাহার তুলনা আরও লাগসই হয়। রাক্ষুসে দেশে ইনিই একমাত্র রামভক্ত, শুধু কালাপানি পার হইয়া ও-পার পর্যন্ত এখনও পৌঁছিতে পারেন নাই। বুদ্ধত্ব (ইংরেজত্ব) লাভের পর তিনি অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান লিখিয়াছেন। এই নামের আননোন কথাটি ব্যঙ্গার্থে প্রযুজ্য হইয়াছে, কারণ লেখক ভালোই জানিতেন যে পুস্তকটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘আননোন ইন্ডিয়ান’ ‘নোন ইংরেজি নবিস’ হইয়া খ্যাতি অর্জন করিবেন।হইয়াছেও তাহাই। গরু খাইয়া অনেক হিন্দু মুসলমান-সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করিয়াছেন, স্বদেশের বদনাম করিয়া নীরদ সি চৌধুরীও ইংরেজ-মহলে খ্যাত্যাপন্ন হইলেন। সুতরাং ইনি যদি স্টেটসম্যান-এ বাংলা সাহিত্যকে হেয় প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিয়া থাকেন, তাহাতে অবাক হইবার কিছু নেই—যাহারা চেল্লাচিল্লি করিয়াছেন, তাঁহারাই মূর্খ।’
রবীন্দ্রনাথকে কম গাল দেননি সজনীকান্ত। কিন্তু তাঁর জীবনে অন্যতম কীর্তি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে দুটি গ্রন্থ রচনা। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় যখন তাঁর পথের পাঁচালীর কোনো প্রকাশক পাচ্ছিলেন না, স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসেন সজনী। নিজেরও আর্থিক সংকট। এর মধ্যেই পাঁচজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পথের পাঁচালী প্রকাশক হন এবং বিভূতিভূষণকে ৩২৫ টাকা রয়্যালটিও দেন। তার পর বিভূতিভূষণকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি (কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর, সবিতেন্দ্রনাথ রায়)। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যও এভাবে নিজের কাঁধে বোঝা নিয়েছেন সজনীকান্ত দাস (১৯০০-১৯৬২)। এই সজনীই লিখেছেন:
খাল কাটিয়া বান ঢোকালে সরস্বতীর অন্দরে
এখন কেন নাক ডাকিয়া হাঁকছ, ‘লাগে গন্ধ রে।’
বয়স-ভুলে করলে কি
টানলে কোলে সব মেকি!
ভিড়ম্ব তোমার সোনার তরী হায় বেনামী-বন্দরে।
মাইকেল মধুসূধন দত্ত লিখেছিলেন মেঘনাদবধ কাব্য। সজনীকান্তকে তাই লিখতে হয়েছে মাইকেলবধ কাব্য।
কেবল হুল ফোটানো সংবাদের ওপর ভর করে সজনী-বিচার করলে সুবিচার করা হবে না। সজনীর যারা ‘ভিকটিম’, তাঁরা যখন বিপদাপন্ন, নজরুলের চিকিৎসা সহায়তা, জীবনানন্দের জীবন বাঁচাতে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে আসা, সমরেশ-বুদ্ধদেবের বই যখন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের লড়াই করা—সজনীকান্ত অগ্রণী ছিলেন সবটাতেই।