স্পোর্টস ডেস্ক(১৬ জানুয়ারী): ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকারের জন্মভারতে, ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল। টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে ‘১০০ সেঞ্চুরি’রমালিক তিনি; এই দুই ধরনের খেলায় রান করেছেন ৩৪ হাজারেরও বেশি। ওয়ানডেক্রিকেটে একমাত্র দ্বিশতক রানের রেকর্ডটিও তাঁর। সম্প্রতি ওয়ানডে ক্রিকেটথেকে অবসর নিয়েছেন এই ক্রিকেট-বিস্ময়।
আমি ২৩ বছর ধরে আন্তর্জাতিকক্রিকেট খেলছি। তার পরও আমি প্রতিবছরই নতুন থেকে নতুন কিছু শিখছি। গত বছরসবাই আমার শততম শতকের দিকেই নজর দিয়েছিল। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত লক্ষ্যসেটা ছিল না; দলকে জেতানোর জন্য আমার সব সময়ের লক্ষ্য ছিল রানের জন্য, বড়ধরনের রানের পাহাড় তৈরি করা। অতীতের মতোই দলের জন্য সেঞ্চুরি করা।
আমিসব সময় আমার কোচ রমাকান্ত আচরেকারের কথা স্মরণ করি। তাঁর কথা ছিল, খেলারমাঠের পরিস্থিতি যেকোনো সময় কঠিন আকার ধারণ করতে পারে। সেই কঠিন সময়নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছুই নেই। তোমাকে তোমার মতো করে খেলে যেতে হবে। খারাপসময় একসময় চলে যাবেই। যাত্রাপথে তোমার সব বাধা তোমাকেই নিজে থেকে টপকেজয় করতে হবে।
স্কুলজীবন থেকে আমি অনেক কিছু শিখে চলেছি। তবে সবচেয়েগুরুত্বপূর্ণ হলো ‘খেলাকে ভালোবাসা’। আর খেলার মাঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণহলো খেলার বাইরের কিছু নিয়ে চিন্তা না করা। সব সময়ই বলের ওপর মনোযোগ দিতেহবে, কে কী বলল তাতে মনোযোগ দেওয়া বোকামি। নিজের আবেগকে ধরে রাখতে হবে।তোমাকেই তোমার কঠিন সময়কে মোকাবিলা করতে হবে। তোমাকে যারা উৎসাহিত করে, যাদের কাজ তোমার জন্য অনুকরণীয়, তাদের অনুসরণ করতে পারো।
আমার প্রথমসেঞ্চুরির কথা সব সময়ই মনে পড়ে। দলের যখন ১১৮ রানে চার উইকেট, তখন আমিমাঠে নামি। তখন আমার লক্ষ্য ছিল আউট না হয়ে মাঠে টিকে থাকা। আমি সতর্কতারসঙ্গে বল নির্বাচন করে খেলতে শুরু করি। ধীরগতিতে খেলতে থাকি। আমি ঠান্ডামেজাজে খেলতে থাকি। আমি প্রথম সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যাই। আমি পেছনে ফিরেনা তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই; যার ফলেই শুরু হয় আমার রোমাঞ্চিতক্রিকেট-জীবন।
শততম শতকের দ্বারপ্রান্তে এসেও আমি একই মনোযোগ দিয়েখেলতে থাকি। দেখে-শুনে বল খেলতে শুরু করি। কিন্তু আমার লক্ষ্য সেঞ্চুরিকেছাড়িয়ে দলের রান বাড়ানোর দিকে ছিল। আমি ক্রিজের অপর প্রান্তেরব্যাটসম্যান বিরাট কোহলিকে নিয়ে দলীয় পার্টনারশিপের দিকে মনোযোগ দিই।কিন্তু সেই সময়ই প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ দলের বোলাররা সত্যিকারের কঠিন বোলিংশুরু করে। আমার মনে পড়ে, ব্যাটিং পাওয়ার প্লের সময় বোলার মাশরাফিমর্তুজা আমাকে একটি মেডেন ওভার বোলিং করে, কোনো রানই ছিল না সে ওভারে। আমিতার বল বুঝে তিনটি ভালো শট খেলি কিন্তু ফিল্ডাররা বলগুলো ধরে ফেলে। আমিনিজের ওপর বিশ্বাস রাখি। কারণ, অন্য কোনো এক ভালো দিনে এ তিনটি শট নির্ঘাততিনটি বাউন্ডারিই হতো। খেলার মাঠে মাথা ঠান্ডা রাখা আমাদের এটাই শিক্ষাদেয়, কখনো কখনো নিজের অজান্তেই ব্যাটের কানায় বল লেগে উইকেটের পেছন দিয়েবল বাউন্ডারি স্পর্শ করে; আবার ভালো ব্যাটিং করেও তিনটি সম্ভাব্য চারফিল্ডারের হাতে বাধা পায়। অবশেষে আমি লক্ষ্যে পৌঁছাই সেই কাঙ্ক্ষিত শতকেরঘরে। শততম শতক! আমি প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমার ব্যাটের দিকে তাকাই এবং আকাশেস্রষ্টার পানে তাকাই। মনে মনে বলি, আমার কঠিন যাত্রা অবশেষে শেষ হলো।দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমার শততম সেঞ্চুরির দেখা মিলল। আমি শিহরিত হয়েড্রেসিংরুমের দিকে তাকাই, আমার ব্যাট তাদের পানে তুলে ধরি। আমার কাঠেরব্যাটটি আমার দেশের পতাকার দিকেও তুলে ধরি। আমার দীর্ঘ অভিযাত্রায় আমারদেশ ও জাতি সবাই এই গৌরবের অংশ।
দীর্ঘ ২৩ বছর ক্রিকেট খেললেও গত বছর ছিলভিন্ন রকম। গত বছরে শততম শতক অর্জনের দিকে আমার কোনোই লক্ষ্য ছিল না।লক্ষ্য ও প্রত্যয় ছিল একটাই—বিশ্বকাপ জেতা।
অন্যরা আমার নামে কী বলে, আমার সমালোচনা আমি তা কখনোই গুরুত্ব দিই না। আমি খেলতে পছন্দ করি। কারণ, আমি ক্রিকেটকে ভালোবাসি। কেউ আমাকে জোর করে খেলতে ডাকেনি; আমি স্বেচ্ছায়এসেছি এই ভুবনে। অন্যদের মতামত থাকতেই পারে; সে হিসেবে প্রতিবছরই আমারপক্ষে-বিপক্ষে নানা মত জমা হয়। আমি আমার জন্য প্রয়োজনীয় মতামত, যা আমাকেউৎসাহ দেয়, তাকেই শুধু গুরুত্ব দিই। অনেক সমালোচক টিভির সামনে বসে মতামতদিতে পছন্দ করেন। ওই সমালোচকেরা জানেন না, খেলার মাঠে আমার মনে কী কাজকরছিল, আমার শরীরের কী অবস্থা ছিল। এ জন্যই আমি তাঁদের থেকে দূরে থাকতেপছন্দ করি। আমার পরিবার ও বন্ধুরা এ ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করে। সাধারণমানুষ আমার জন্য প্রার্থনা করে। আমি যেন শততম শতক অর্জন করি, এ জন্য তাদেরউৎসাহ থাকত আমার সঙ্গে সব সময়। আমি এসব সাধারণ মানুষের আবেগের মূল্য দিই।তাদের আগ্রহ ও প্রেরণা আমার কাছে অমূল্য। এ জন্যই বোধ হয় আমি শততমসেঞ্চুরির দেখা পেয়েছি।
২৩ বছরের ক্রিকেটীয় জীবনে সব সময় আমিক্রিকেটকে ভালোবেসেছি। ২০ বছর আগে আমার মানসিক অবস্থা ছিল এখনকার সময় থেকেভিন্ন। ১৭ বছরের তরুণ বয়সে আমি যা করতে পারতাম, তা এই বয়সে এসেও করতেপারি। পানি দিয়ে ভরা অর্ধপূর্ণ গ্লাসকে আমি ‘পানিপূর্ণ’ হিসেবেই দেখি, ‘পানিশূন্য’ নয়। এটা নির্ভর করে প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। আমি সবসময়ই আশাবাদীদের দলে। যখন তুমি পরিশ্রম করবে, তখন তার ফলাফল এমনিতেই দেখতেপারবে।
২০০৩ সালে দলের কোচ জন রাইট আমাকে বিশ্বকাপের সময় কিছু কথাবলেছিলেন। জনের মনে হয়েছিল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমিই প্রথম শততমসেঞ্চুরি করতে পারি। সে আমাকে সব সময়ই উৎসাহ দিয়ে যেত। কোচের কাছ থেকেপ্রত্যেক ক্রিকেটার এটাই প্রত্যাশা করে। কোচের প্রধান কাজ হলো ক্রিকেটারদেরমানসিক দৃঢ়তাকে উৎসাহ দিয়ে তার মনোবল বৃদ্ধি করা। আমার জীবনের দুটি বড়স্বপ্ন ছিল ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলা এবং বিশ্বকাপ জয় করা, কাপটিকে ছুঁয়েদেখা। আমার স্বপ্নগুলো সত্যিই বাস্তবায়িত হয়েছে। সবার উৎসাহ ও আমারউদ্দীপনার কারণেই আমার দীর্ঘ ক্রিকেটীয় জীবনের অভিযাত্রা অবশেষে আরওআলোকিত হয়েছে।
নিউজরুম