কৃষি ডেস্ক(১২ জানুয়ারী):দেশে গাছের চারা বা নার্সারি ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। শুধু রাজধানী কিংবা বড় বড় শহরে নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নার্সারি ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে। বনজ, ফলদ, ফুল, ঔষধি, শোভাবর্ধনকারী গাছের চারা পাওয়া যায় এসব নার্সারিতে।নার্সারি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিশাল কর্মক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে।
তবে কয়েক বছর আগে এই নার্সারি ব্যবসাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়নি। ফলে নানা ধরনের অসুবিধার মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে এ খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের। নার্সারি মালিকেরা ব্যাংকঋণ সুবিধার দাবি করেছেন। তাঁরা চান, রেয়াতি সুদে এ খাতে বিনিয়োগের সুবিধা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের শুধু উচ্চবিত্ত নয়, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্তের রুচির জগতেও পরিবর্তন এসেছে। নিজেদের বাড়ি বা ফ্ল্যাটের শোভাবর্ধনে এখন বাহারি ফুল ও অর্কিডের মেলা চোখে পড়ে। আর গ্রামের লোকজন নিজেদের বাড়ির আশপাশে পতিত জমিতে বিভিন্ন বনজ ও ঔষধিগাছ লাগান। এ কারণে দেশে বিভিন্ন ধরনের চারাগাছের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে গড়ে উঠছে নার্সারি।
জানা গেছে, ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে রাজধানীর গুলশান এলাকায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে নার্সারির ব্যবসা চালু হয়। এরপর ধীরে ধীরে এর প্রসার ঘটে।নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশে ব্যক্তি খাতে মাত্র চার হাজার নার্সারি ছিল।বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ছোট-বড় ১৮ হাজার নার্সারি রয়েছে। রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগর চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরের পাশাপাশি যশোর, বরিশাল ও বগুড়ায় নার্সারি ব্যবসা ভালোভাবে জমেছে। আর জেলা ও উপজেলা শহরেও গড়ে উঠেছে নার্সারি।
মূলত তিনটি মালিকানায় বর্তমানে দেশে নার্সারিগুলো পরিচালিত হয়।ব্যক্তিমালিকানা, রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও এনজিও মালিকানা। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) আওতায় সারা দেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নার্সারি পরিচালিত হচ্ছে। ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিওর আছে দেশব্যাপী ছোট-বড় অনেক নার্সারি।
সাধারণত ফলদ, বনজ, ঔষধি, ফুল ও শোভাবর্ধনকারী চারাগাছই বিক্রি হয় নার্সারিতে। শহরাঞ্চলে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের শোভাবর্ধনে ফুলগাছ ও শোভাবর্ধনকারী চারাগাছের চাহিদা বেশি। তবে জেলা শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফলদ, বনজ ও ঔষধিগাছের চাহিদা বেশি। একটি চারাগাছের দাম ধরনভেদে তিন থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত।
জানা গেছে, মাঝারি আকারে নার্সারি ব্যবসা শুরু করতে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা প্রয়োজন হয়। তবে নার্সারির জন্য জমি প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগের পরিমাণ। এক বিঘার মতো জমি হলেই একটি মাঝারি আকারের নার্সারি গড়ে তোলা সম্ভব। একটি মাঝারি নার্সারিতে চার-পাঁচজন কর্মী লাগে। এ ছাড়া মাটি, টব, ব্যাগ, গোবরের সারা বছরের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়।
বাংলাদেশ নার্সারি মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে এই খাতে দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। প্রায় এক লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে। আর এ খাতের পশ্চাদমুখী খাত বিবেচনা করলে পাঁচ লাখ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে।নগরায়ণের ফলে মালির চাহিদা কমে গেছে। একসময় যাঁরা মালির পেশায় জড়িত ছিলেন, তাঁরাই এখন নার্সারিতে কাজ করেন।
রাজধানীর বড় রাস্তার পাশে যেসব নার্সারি রয়েছে তা মূলত সরকারি জমি। তবে নিজস্ব জমিতে নার্সারি করতে খরচ বেশি পড়ে। রাজধানীর বিমানবন্দর সড়ক, বনানী, শেরেবাংলা নগর, রমনা ও সোহ্রাওয়ার্দী পার্ক এলাকায় নার্সারি গড়ে উঠেছে। জমিস্বল্পতার কারণে রাজধানীর আশপাশের এলাকা থেকে সিংহভাগ চারাগাছের সরবরাহ দেওয়া হয় এসব নার্সারিতে।
তবে নার্সারি ব্যবসা শুরু করতে ব্যাংকঋণ পান না এই খাতের উদ্যোক্তারা। নিজেদের পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা শুরু করতে হয়। এই প্রসঙ্গে নার্সারি মালিক সমিতির সদ্য বিদায়ী মহাসচিব সাদিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ব্যবসায় যাঁরা আসেন, তাঁরা অন্য উদ্যোক্তাদের মতো ধনী নয়। মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনই আসে এই ব্যবসায়। তাই ব্যাংকে বন্ধক দেওয়ার মতো কোনো জমি বা সম্পদ থাকে না তাঁদের। বন্ধক না দিলে ব্যাংকও ঋণ দিতে চায় না।’ কৃষি খাতের মতো এই শিল্পে ২ শতাংশ হারে ব্যাংক ঋণের সুযোগ দেওয়ার দাবি করেন তিনি।
জানা গেছে, এ ছাড়া নার্সারি ব্যবসা এখনো সরকার স্বীকৃত কোনো ব্যবসা নয়। স্বীকৃত ব্যবসা না হওয়ায় ব্যাংকঋণ প্রাপ্তির অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। তবে সম্প্রতি নার্সারিগুলোর নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
রপ্তানি সম্ভাবনা: সারা বিশ্বেই এখন উৎসব উপলক্ষে গোলাপ, রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন রকমের ফুলের চাহিদা রয়েছে। চাহিদা রয়েছে শোভাবর্ধনকারী অর্কিড, পাতাবাহার, জারবেরির মতো গাছের।কিন্তু পর্যাপ্ত সরকারি সুবিধা না থাকায় এখনো পুরোপুরি রপ্তানি করা যাচ্ছে না। তবে বিভিন্ন দেশে নমুনা পাঠানো শুরু করেছে নার্সারি মালিকেরা। সীমিত আকারে রপ্তানিও হচ্ছে।
নার্সারি মালিক সমিতির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে জানান, রপ্তানি করতে হলে কমপক্ষে ২০ বিঘা জমি নিয়ে নার্সারি করতে হবে। কেননা, বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা অনেক বেশি থাকে।কিন্তু যাঁরা নার্সারি ব্যবসায় জড়িত তাঁদের এত পুঁজি খাটানোর মতো সামর্থ্য নেই। তাই শহরাঞ্চলের রাস্তার পাশে পতিত জমিগুলো নার্সারি তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে এসব এলাকায় অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যক্রমও কমবে।
নিউজরুম