রুপসীবাংলা ডেস্ক (১১জানুয়ারী) : শীতে কাবু পুরো দেশ। বাড়ছে শীতের মাত্রা। সেসঙ্গে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। এ পর্যন্ত অন্তত ১২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বয়স্ক। তারা হার্ট অ্যাটাক, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। গত ১০ দিনে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে মৃতের এ সংখ্যা পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে মৃতের এ সংখ্যা বলা হয়েছে ৮৫। তবে সরকারি তরফ থেকে এখনও এ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। মৃতদের মধ্যে রয়েছে হবিগঞ্জে ২২ জন, রাজারহাটে ৫, মানিকগঞ্জে ৪, বিশ্বনাথে ৩, বেনাপোলে ৬, মনিরামপুরে ৬, কাজীপুরে ৪, গলাচিপায় ২, ভাণ্ডারিয়ায় ৩, রৌমারীতে ৫, বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জে ১৪, রংপুরে ৮, বরিশালে ৫ জন। মৃতের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি সাহায্যের পরিমাণ। এখনও সরকারি সাহায্য পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন শীর্তাতরা। এমনকি বেসরকারি পর্যায় থেকেও সাহায্যের পরিমাণ একেবারে কম। এদিকে বুধবারের তুলনায় গতকাল দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও বেশি শীত পড়েছে।
কমে গেছে তাপমাত্রা। আগের দিনের চেয়ে গতকাল তাপমাত্রা আরও নিচে নামে। নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলায় বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে একদিনের মাথায়।
আগের দিন দিনাজপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্র ছিল বরিশালের খেপুপাড়ায় ২০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহ আলম বলেন- রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেটে আজও শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। তবে আগামীকাল থেকে তাপমাত্রা কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, শীতে সর্বত্রই মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় শীতবস্ত্র বিতরণের হার বাড়েনি। এখনও খুব সামান্য জায়গায় সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য পৌঁছেছে। তবে যেখানে পৌঁছেছে সেখানে সাহায্যের পরিমাণ একেবারেই কম। অনেক জায়গায় শীতবস্ত্রের অভাবে মানুষ চরম কষ্ট পোহাচ্ছে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে থাকছে বিস্তারিত- স্টাফ রিপোর্টার, হবিগঞ্জ : বৃহস্পতিবার হবিগঞ্জে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হবিগঞ্জের ইতিহাসে এটা সর্বনিম্ন বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও শৈত্যপ্রবাহে হবিগঞ্জে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধদের সংখ্যা বেশি। শুধুমাত্র হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে পহেলা জানুয়ারি থেকে ১০ই জানুয়ারি পর্যন্ত ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২২ শিশু মৃত্যুবরণ করেছে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার মৃত্যুবরণ করেছে ৫ শিশু। ৫৫ শিশু ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। গত ১০ দিনে সদর হাসপাতালে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রোগী ভর্তি হয়েছেন ৫৬০ জন। প্রচণ্ড এ শীত থেকে বাঁচতে সাধারণ ও ছিন্নমূল মানুষেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন শহরের শায়েস্তানগর, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রাঙ্গণে, কোর্ট স্টেশন, পৌর মার্কেটে ও চৌধুরী বাজারের হকার্স মার্কেটগুলোতে।
রাজারহাট (কুড়িগ্রাম): গত ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আয়শা নামের (৬৫) এক বৃদ্ধা আগুন পোহাতে গিয়ে পুড়ে মারা গেছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এ টি এম আনোয়ারুল হক প্রামাণিক জানান, গত ৪৮ ঘণ্টায় বৃদ্ধা ও শিশু ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩০ জন ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। গত ৪ দিনের টানা শৈত্যপ্রবাহে বোরো বীজতলা, আলুক্ষেত, বেগুনসহ রবিশস্যের ক্ষেতে কোল্ড ইনজুরি দেখা দিয়েছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাজারগুলো মানুষশূন্য হয়ে পড়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষজন শীতের গরম কাপড় কিনতে না পারায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছে। মানিকগঞ্জ : ঘিওরে গত রাতে এক শিশুসহ দু’জন মারা গেছেন।এ নিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেলেন ৪ জন।
বিশ্বনাথ (সিলেট) : তীব্র শীতে বিশ্বনাথে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ১৬ই ডিসেম্বর সংসদ সদস্যের নামে ৩২৭টি কম্বল বরাদ্দ পায় পিআইও অফিস। কিন্তু উপজেলার জনসংখ্যার তুলানায় এ কম্বল খুবই কম। উপজেলা নির্বাহী আফিসার সোনামণি চাকমা বলেন, সংসদ সদস্যের বরাদ্দ ছাড়া উপজেলায় সরকারিভাবে আর কোন বরাদ্দ নেই।
বেনাপোল: বেনাপোলে গত কয়েক দিনে মারা গেছেন ৬ জন। এদের মধ্যে ৩ জন পুরুষ ও ৩ জন মহিলা। কোল্ড ইনজুরিতে সীমান্ত এলাকায় মাঠের পর মাঠ বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। মণিরামপুর (যশোর): মঙ্গলবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদিকে তীব্র শীতে শিশুরা নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া গবাদি পশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাও যাচ্ছে।
কালকিনি (মাদারীপুর) : তীব্র শৈত্যপ্রবাহে কালকিনি পৌর এলাকার পশ্চিম মিনাজদি গ্রামে বুধবার রাতে আবুল কাশেম ঘরামী (৭৫) নামের এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে শিশু ও বয়স্ক রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। নীলফামারী : পৌষের কনকনে শীতে আরও ১ বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে গত ৩ দিনে জেলায় শীতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৭।
দৌলতপুর (কুষ্টিয়া): কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে তীব্র শীত ও শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকায় জনজীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। গতকাল ভোরে তীব্র শীতে পাতাজান খাতুন (৭২) নামে আরও একজন বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে গত ২ দিনে তীব্র ও শীতজনিত রোগে দৌলতপুরে ৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে। কাজীপুর: হাড়কাঁপানো শীত, ঘনকুয়াশা আর স্মরণকালের শৈত্যপ্রবাহে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। কাজীপুরের প্রতিটি ইউনিয়নে শীতবস্ত্রের যে সরকারি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাফিউল ইসলাম শাফি জানান, প্রথম পর্যায়ে ৬০০ এবং দ্বিতীয়বার ১০০০ কম্বল এসেছিল।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় বিগত দিনের চেয়ে আজ শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রংপুর আবহাওয়া অফিস জানায় গতকালের চেয়ে বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা আরও নেমে এসেছে। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০ দিনে ২৬ শিশু ও ৬ বৃদ্ধসহ ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আজ সকালে ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। ফলে শীতের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে ।
গলাচিপা (পটুয়াখালী) : দ্বিতীয় দফা শৈত্যপ্রবাহ শুরু হওয়ায় গলাচিপা উপজেলার সর্বত্র ঘনকুয়াশা, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ও তীব্র শীতের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছে হতদরিদ্র মানুষ। গত ৫ দিনে গলাচিপায় শীতজনিত রোগে ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ভাণ্ডারিয়া : গত দু’দিনের তীব্র শীতে ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় কমপক্ষে ৩ জন মারা গেছেন। শীতের কারণে ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে সর্দি, কাশি, নিউমনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগ। শীতবস্ত্রের চরম অভাব দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে কয়েক শ’ কম্বল বিতরণ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে স্কুল-মাদরাসার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে।
রৌমারী (কুড়িগ্রাম): গত তিনদিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫ জন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। রৌমারী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রতিনিয়ত ভিড় করছে শ’ শ’ রোগী। রৌমারী হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, তীব্র শীতের কারণে বয়স্ক ও শিশুদের নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, আমাশয়ে আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। অপরদিকে বীজতলা ও রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
হাতীবান্ধা (লালমনিরহাট) : নিজ গড্ডিমারী গ্রামের রওশন হাবীব (৭৫) নামে একবৃদ্ধ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার সারওয়ার হোসেন জানান, চাহিদার তুলনায় শীতবস্ত্র বরাদ্দ কম। এরপরেও কয়েক হাজার কম্বল ইতিমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
বদরগঞ্জ (রংপুর): গত সাতদিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন নারীসহ ১৪ জন। সরকারিভাবে দুই উপজেলার লক্ষাধিক হতদরিদ্রের মাঝে এখন পর্যন্ত কম্বল বিতরণ করা হয়েছে ২৬০০টি। বদরগঞ্জ উপজেলার আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা চিকিৎসক ফরিদুল ইসলাম ওরফে পলাশ বলেন, সর্দি-কাশিসহ শীতজনিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের সীমাহীন কষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালে এসব রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে।
রংপুর : এ পর্যন্ত সেখানে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। শীতজনিত হাঁপানি, নিউমোনিয়া, কাশি, জ্বরসহ বিভিন্ন রোগে শতাধিক লোক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি রয়েছেন। আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক আতিকুর রহমান জানান, তাপমাত্রা সর্বনিম্নে ৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। এদিকে ২০ লাখ শীতবস্ত্রের প্রয়োজন হলেও রংপুর জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আবদুস সালাম জানান, সরকারিভাবে ৩০ হাজার শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৩ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে।
বরিশাল : বরিশালে ইতিহাসের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করছে। বুধবার দুপুর পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে বরিশাল আবহাওয়া অফিস। গত ২ দিন ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল হাসপাতালে বুধবার শীতজনিত রোগে মারা গেছেন ৩ জন। গতকাল মারা গেছেন আরও ২ জন।
নিউজরুম