ডেস্ক রির্পোট (১১জানুয়ারী) : ২০০৭ সালের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির মতো একটি একতরফা নির্বাচন করে সরকার গঠনের কথা ভেবেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এ ধরনের কোন কিছু মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। তিনি এমন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
সেনাবাহিনী ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ করে অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে, কিংবা দুই নেত্রীকে নির্বাসনে পাঠানো হতে পারে- এমন কোন আশঙ্কা মনে ঠাঁই দিতে প্রস্তুত ছিলেন না সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এ দু’টিকে ‘গুজব’ হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনাও। তিনি বরং রসিকতা করে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসন দিলে তার জন্য ভালই হবে। তাতে তিনি নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। এ সময় তিনি দেশে সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী যদি হস্তক্ষেপ করেই এবং তারা যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই পারে- তাহলে সেটা ভালই হবে। ১/১১ ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের মনে। উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্রের যেসব গোপন তারবার্তা প্রকাশ করেছে তাতে এসব কথা বলা হয়েছে। ২০০৭ সালের ৬ই জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ. বিউটেনিস ও বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন শেখ হাসিনার সঙ্গে।
এর পরের দিন ৭ই জানুয়ারি তারা সাক্ষাৎ করেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। এ বিষয়ে ওই বছরের ৮ই জানুয়ারি বিউটেনিস গোপন তারবার্তা নম্বর ৩২, পাঠান ওয়াশিংটনে। এতে তিনি লিখেছেন- ৬ই জানুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী সাক্ষাৎ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। এ সময় তারা বলেন, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কিছু নেতা তাদের কাছে কিছু সমঝোতা প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, এতে বিরোধী দল বিএনপি’র সমর্থন রয়েছে। এ জন্য তারা শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন। এতে বলা হয়, রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি তাতে শেখ হাসিনাকে ও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়াকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানো হতে পারে এবং পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে। এ সময় বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরী এ বিষয়ে তাদের সমর্থন নেই, অথবা তারা এমন প্রস্তাবকে উৎসাহী করেন না বলে জানান। এ সময় তারা বলেন, দুই নেত্রীর বলিষ্ঠ ভূমিকায় রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান হতে পারে। তবে শেখ হাসিনা জোর দিয়ে এ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেন। সরাসরি হোক বা জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে হোক সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে তার কোন আপত্তি ছিল না। শেখ হাসিনা বলেছেন, যদি সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করেই এবং তারা ভাল কিছু করে তাতে কোন অসুবিধা নেই।
তবে তিনি মার্শাল ল’র আশঙ্কা করেননি। তার মতে, অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য শক্তিশালী সেনা অফিসার নেই। তারপরও তার আস্থা ছিল, রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের চেয়ে বেশি সময় সেনাবাহিনীকে জনতা ক্ষমতায় থাকতে দেবে না। তিনি বলেন, যদি সেনাবাহিনী ক্ষমতা থেকে সরে যেতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে সহিংসতা, রক্তপাতের সৃষ্টি হবে। দেশ ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। শেখ হাসিনা যুক্তি দেখান, ওই সময়ের রাজনৈতিক অচলাবস্থা ছিল বিএনপি’র পরিকল্পনার সরাসরি ফল। তারা প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে এমন কাজ করেছে। তারা আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটকে নির্বাচন বয়কটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি আস্থার সঙ্গে ঘোষণা দেন, আমরা নির্বাচনে বিজয়ী হবো, এই ভয়ে তারা আমাদের নির্বাচনে নিতে চায় না। তিনি অভিযোগ করেন প্রেসিডেন্ট/প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তার উপদেষ্টা বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথায় কর্ণপাত করছেন না। তিনি শুধু বিএনপি’র নির্দেশনা অনুসরণ করছেন। প্রেসিডেন্ট যে করেই হোক নির্বাচন করে ক্ষমতা তুলে দিতে চান খালেদা জিয়ার হাতে।
এর মধ্য দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের সামনে নির্বাচন বয়কট ছাড়া আর কোন বিকল্প রাখছেন না। তাকে এ সময় প্রশ্ন করা হয়, যদি খালেদা জিয়া কোন সমাধান প্রস্তাব নিয়ে আসেন তাহলে তিনি কিভাবে নেবেন। হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে এরকম কোন আলোচনার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন। এ সময় দুই রাষ্ট্রদূত বিএনপি’র কিছু নেতার প্রস্তাব তুলে ধরেন। যাতে বলা হয়, নির্বাচন হওয়ার পর পরবর্তী ১২ মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন দেয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে হাসিনা ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার চেয়ে সমস্যা সমাধানে সামরিক বাহিনীর জড়িত হওয়াকেই তিনি সমর্থন করবেন। শেখ হাসিনা বলেন, ড. ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টা মেনে নেয়ায় প্রথম দিক থেকেই তার সমর্থকরা তাকে দায়ী করছেন। রাজপথের আন্দোলনের ফলে প্রধান উপদেষ্টার পদ নিতে অস্বীকৃতি জানান তখনকার প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান। অনেকে বলেন, ড. ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টা বানানোয় তিনি নির্বাচনে কারসাজি করবেন। তার চেয়ে ওই কেএম হাসানই ভাল ছিলেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মনোনয়ন বাতিল করায় শেখ হাসিনা নির্বাচন বয়কট করছেন কিনা এমন কথা অস্বীকার করেন শেখ হাসিনা। প্যাট্রিসিয়া এ. বিউটেনিস মন্তব্য করেন, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসকে সেনাবাহিনী থেকে জানানো হয়েছে, সামরিক অভ্যুত্থান তাদের লক্ষ্য নয়। সেনাবাহিনী যা কিছু করবে তা হবে সংবিধানের আলোকে। এরপর ৭ই জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন প্যাট্রিসিয়া এ. বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরী। ওই বৈঠক সম্পর্কে বিউটেনিস ২০০৭ সালের ৯ই জানুয়ারি ঢাকা-০০০০৩৯ নম্বর তারবার্তা পাঠান ওয়াশিংটনে। এতে তিনি বলেন, কোন ধরনের সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে খালেদা জিয়া পাল্টা অভিযোগ তোলেনÑ কথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যই এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। তবে দুই রাষ্ট্রদূতই এ অভিযোগ অস্বীকার করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিউটেনিসের পাঠানো বার্তায়। খালেদা দুই কূটনীতিকের কাছে দাবি করেন, তিনি সব সময়ই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বসতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা কখনওই সাড়া দেননি। ‘এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে’। উল্লেখ করে খালেদা জিয়া সমঝোতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ২২শে জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন। এর বদলে খালেদা প্রস্তাব দেন, পুনর্নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী ভোটার পরিচয়পত্র প্রবর্তনসহ নির্বাচন কমিশনে সংস্কার করে ১২ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে তিনি আবারও নির্বাচন দিতে পারেন। উটেনিস লিখেছেন, ২০০৭-এর ২২শে জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন হলে অনেকেই যে প্রশ্ন তুলবে- সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন খালেদা।
.তবে তার যুক্তি ছিল, প্রশ্ন উঠলেও তার সেই সম্ভাব্য সরকার হবে সাংবিধানিকভাবে বৈধ। আলোচনার এক পর্যায়ে বিউটেনিস প্রশ্ন রাখেন, দেশের প্রায় অর্ধেক ভোটার যদি ২২শে জানুয়ারির নির্বাচন মেনে না নেয়, সেক্ষেত্রে বিএনপি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে কি-না। কিন্তু দেশের মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেবে- এমন সম্ভাবনা হেসেই উড়িয়ে দেন খালেদা জিয়া। বড় ধরনের গণআন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সামর্থ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। দুই কূটনীতিক বিএনপি চেয়ারপারসনকে জানান, সংবিধান পরিপন্থী যে কোন ঘটনা এড়াতেই তারা রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।
এসব বিষয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গেও কথা বলেছেন তারা। মন্তব্যে বিউটেনিস লিখেছেন, বিএনপি’র একতরফা নির্বাচন পরিকল্পনার সমালোচনা করায় খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলে জানতে পেরেছেন তারা।
খালেদা জিয়ার ধারণা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের পিঠ এবার সত্যি সত্যি দেয়ালে ঠেকে গেছে এবং এ অবস্থা থেকে তারা আর ফিরে আসতে পারবে না।
নিউজরুম