১১ জানুয়ারি, ২০১৩।।
বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে শিক্ষকদের বেতনভাতা বা নায্য সুযোগ-সুবিধা দেয়ার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করতে হয়। আর এ দেশে শিক্ষকদের দাবি নিয়ে ভোটের রাজনীতি করা হয়। কিন্তু মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের নায্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া যে রাষ্ট্রের কর্তব্য তা বিবেচনা করা হয় না; বরং তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া এক ধরনের অনুগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কোনো ধরনের সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিক্ষকেরা মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার বা এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলন করছেন। পুলিশ সেই আন্দোলন দমনের জন্য তাদের ওপর হামলা করেছে। টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করে কমপক্ষে ২৫ জন শিক্ষককে আহত করেছে। শিক্ষকদের এই আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের লোকজন আছে বলে এক পুলিশ কর্মকর্তা টেলিভিশনের সামনে বক্তব্য রাখছেন। সরকারের চার দিকে এখন জামায়াত-শিবিরের ভূত ভর করেছে। যেকোনো ধরনের আন্দোলন দমনের উপায় হিসেবে জামায়াত-শিবিরের উপস্থিতি হাজির করা হচ্ছে। পুলিশ এখন পুরোপুরিভাবে দলীয় লাঠিয়ালে পরিণত হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষকেরা কোনো দলের নয়। তারা তাদের জীবনমান উন্নয়ন কিংবা বেঁচে থাকার তাগিদে এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। একে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক আন্দোলন বলে চিহ্নিত করা ভুল হবে। যখনই কোনো দাবি নিয়ে কেউ আন্দোলনে নামে তাকে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করে সরকার আন্দোলন দমনে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ কিংবা দলীয় বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। গত দিন রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে সচেতন শিক্ষক সমাজের ব্যানারে আন্দোলনত শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অ্যাসিড নিক্ষেপ করে। এতে দুই শিক্ষকের শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যায়। সেই যা-ই হোক, নন-এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যখন প্রেস কাবের সামনে পেটানো হচ্ছে, তখন প্যারেড ময়দানে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের নামে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ঘোষণা দেয়া হলো। ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে বিজয়ী করতে মাঠপর্যায়ে তাদের পক্ষে কাজ করতে বলা হলো। অথচ এই জাতীয়করণের ঘোষণার মধ্যেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁক। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন তিন ধাপে রেজিস্টার্ড ও নন-রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হবে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত আছে এমন বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ কার্যকর হবে জানুয়ারি থেকে। নন-এমপিও রেজিস্টার্ড ও নন-রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ শুরু হবে জুলাই থেকে, বাকিগুলো হবে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে। অর্থাৎ এমপিওভুক্ত স্কুলগুলো ছাড়া বাকিগুলো প্রতিশ্রুতির মধ্যে থেকে যাচ্ছে। আগামী বছরে যেসবের ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেগুলো অনিশ্চিত থেকে যাবে। কারণ এর মধ্যে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কার্যত এই ঘোষণার মাধ্যমে শিক্ষকদের নিয়ে ভোটের রাজনীতি সমাধা করা হলো মাত্র।
শিক্ষকদের সম্মান মর্যাদা ও নায্য সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য রাজনীতি ও নিপীড়ন দুই পথ বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের ওপর পুলিশি আক্রমণের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে, সরকার শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে আন্তরিক নয় বরং তাদের নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল প্রধান লক্ষ্য। আমরা সরকারের এ ধরনের নীতির নিন্দা করি। পর্যায়ক্রমে সব শিক্ষকের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।