১১ জানুয়ারি, ২০১৩।।
সহযোগী এক দৈনিকের শীর্ষ সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের কারাগার এখন রাজবন্দিশালায় পরিণত হয়েছে। বন্দীদের নিয়ে বেকায়দায় আছে কারা প্রশাসন। বন্দীদের আবাসন, আদালতে আনা-নেয়া, চিকিৎসা, নিরাপত্তাসহ বহু ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপ। দেশের ৬৮টি কারাগারে দিন দিন বাড়ছে বন্দিচাপ। এর মধ্যে রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যাই বেশি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী রাজনৈতিক বন্দীদের শীর্ষে এখন জামায়াত। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। বর্তমানে দেশের কারাগারগুলোয় বন্দিধারণমতার কয়েক গুণ বন্দী থাকায় কারাগারগুলোতে চলছে এক ধরনের অস্থিরতা। পাশাপাশি নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা। রাজনীতির মাঠ যত উত্তপ্ত হচ্ছে, ততই বাড়ছে রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা। তিন মাস আগেও এ অবস্থা ছিল না। জামায়াতের আমির, সেক্রেটারি জেনারেলসহ প্রায় সব কেন্দ্রীয় নেতাই এখন কারাগারে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাই এখন রাজবন্দী।
এর আগের অন্য এক খবরে বলা হয়েছে, দুর্ধর্ষ খুনি, ফাঁসির আসামি ও ভয়ঙ্কর জঙ্গিদের আটকে রাখার জন্য নির্মিত কাশিমপুরের হাই-সিকিউরিটি টর্চার সেলে আটক রাখা হয়েছে কারারুদ্ধ বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের রাজবন্দীদের। সঙ্কীর্ণ সেলে গাদাগাদি করে রাখা নেতাকর্মীদের মাথার ওপর ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে হাই-ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক বাল্ব। দম বন্ধ হওয়া কবরসদৃশ সেলে আটক বন্দীদের অনেকেরই চোখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে চোখধাঁধানো আলোয়। সারা দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধির সাথে সাথে গণহারে গ্রেফতারের ঘটনা বাড়ছে। বর্তমানে দেশের ৬৮ কারাগারে বন্দীর সংখ্যা লক্ষাধিক আর এসব কারাগারের ধারণক্ষমতা হলো ২৭ হাজার। একজনের জায়গায় থাকছে চারজন। রাজনৈতিক বন্দীদের সেলে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। একজনের জায়গায় পাঁচ থেকে ছয়জনকে রাখা হচ্ছে। কারা কর্তৃপক্ষ এসব বন্দীর যেমন থাকার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হচ্ছে তেমনি দেয়া হচ্ছে না প্রয়োজনীয় খাবার। ওষুধ পর্যাপ্ত থাকলেও তা বন্দীদের দেয়া হচ্ছে না। প্রচণ্ড শীতে বন্দীরা কাবু হয়ে পড়লেও তাদের পুরনো দুর্গন্ধযুক্ত ছেঁড়া কম্বল ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে।
দেশের কারাগারগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল অপরাধীদের রাখার জন্য, যাতে বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের শাস্তি দিয়ে সমাজের আইনশৃক্সলা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। কিন্তু সে অবস্থা এখন যেন আর নেই। এখন চোর, ডাকাত, অপরাধীদের চেয়েও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেলে পাঠানোর জন্য বেছে নেয়া হচ্ছে বেশি। এতে দুই ধরনের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এক দিকে অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে বাইরে। এতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। আর রাজনৈতিকভাবে সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণ করা ছাড়া যাদের আর কোনো অপরাধ মূলত নেই তাদের দিয়ে ভর্তি করা হচ্ছে কারাগার। দেশের অপরাধপ্রবণতাকে সামনে রেখে কারাগারগুলো তৈরি করা হয়েছিল বলে আকস্মিকভাবে রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে জেল ভর্তি করার বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাথায় ছিল না। ফলে একজনের স্থানে চার বা পাঁচজন বন্দী রাখতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। বন্দীদের মধ্যে এমন মেয়েও রয়েছেন, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে হিজাব পরে কোনো বাসায় অথবা প্রেস কাবের আলোচনা সভায় যাওয়ার জন্য। এসব বন্দীর অনেকেই মেডিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, এমনকি ছয় মাসের গর্ভবতী এক মেয়েকেও ৫৪ ধারায় চালান দেয়া হয়েছে। দেশের প্রধান প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আটক করা হয়েছে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে। এ অবস্থা কিছুতেই রাষ্ট্রের দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আমরা মনে করি, কোনো গণতান্ত্রিক ও সহনশীল সরকার অপরাধীদের পরিবর্তে রাজবন্দীদের দিয়ে এভাবে কারাগার ভর্তি করার নীতি গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৪০ বছরে এত রাজবন্দী কোনো সময় কারাগারে ছিল না। মতের ভিন্নতার জন্য নানা অজুহাতে মামলা দিয়ে বা ৫৪ ধারায় বন্দী করে এভাবে কারাগার ভর্তি করে দেশে শান্তি আনা সম্ভব হলেও হতে পারে। তবে সে শান্তি হবে কবরের নিস্তব্ধতার মতো। আবার ঝড়ের আগমুহূর্তের নিস্তর স্থিরতাও হতে পারে এটিÑ যার পরে প্রলয়ঙ্করী বাতাস সব কিছুকে দুমড়ে-মুচড়ে নিয়ে যায়। কোনো দেশ বা সরকারের জন্য এ ধরনের অবস্থা কাম্য হতে পারে না। সবার উচিত গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার প্রতি সম্মান দেখানো।