শিক্ষা ডেস্ক(১০ জানুয়ারী): ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাদিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে এসব বিদ্যালয়ে কর্মরত একলাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারি হলো।
গতকাল বুধবার রাজধানীরজাতীয় প্যারেড স্কয়ারে শিক্ষকদের এক বিশাল সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণাদেন। সারা দেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষক অংশ নেন এই সমাবেশে।
প্রধানমন্ত্রীরএই ঘোষণার মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের দীর্ঘ দুই দশকের আন্দোলন সফল হলো। ১৯৯১ সালথেকে জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরশিক্ষকেরা।
প্রধানমন্ত্রী সমাবেশে বলেন, ‘শিক্ষকদের এ দাবি কতটাযৌক্তিক, আমি সেটা উপলব্ধি করেছি। ওনারা শুধু রেজিস্টার্ড প্রাথমিকবিদ্যালয়ের জাতীয়করণ চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা স্থায়ী-অস্থায়ীনিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত, কমিউনিটি, সরকারি অর্থায়নে এনজিওপরিচালিত, পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত এবং পাঠদানের অনুমতিরঅপেক্ষাধীন সবগুলোরই সরকারীকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রীবলেন, এখন সরকারীকরণের আশায় নতুন করে যত্রতত্র বিদ্যালয় করলে অনুমোদন দেওয়াহবে না। প্রয়োজন হলে সরকারিভাবেই বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। তবে যেবেসরকারি বিদ্যালয়গুলো এখন আছে, সেগুলো থাকবে।
শেখ হাসিনা এ উদ্যোগেরআর্থিক দিকটি তুলে ধরে বলেন, ‘এই জাতীয়করণের ফলে অনেক টাকা প্রয়োজন। কিন্তুনিয়ত ভালো থাকলে সবকিছু করা সম্ভব।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়েরভারপ্রাপ্ত সচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীরঘোষণার পর জাতীয়করণ হয়েই গেছে। তবে আনুষ্ঠানিকতার জন্য দু-এক দিনের মধ্যেইগেজেট প্রকাশ করা হবে।
যেভাবে কার্যকর: জাতীয়করণের এ সিদ্ধান্ত তিনস্তরে কার্যকর হবে। এর মধ্যে চলতি মাসের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ হাজার ৯৮১টিরেজিস্টার্ড (এমপিওভুক্ত) বিদ্যালয়ের ৯১ হাজার ২৪ জন শিক্ষক এ সুবিধাপাবেন। আগামী ১ জুলাই থেকে স্থায়ী-অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানেরঅনুমতিপ্রাপ্ত কমিউনিটি এবং সরকারি অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দুই হাজার২৫২টি বিদ্যালয়ের নয় হাজার ২৫ জন শিক্ষক সুবিধা পাবেন। আর তৃতীয় স্তরে ২০১৪সালের ১ জানুয়ারি থেকে পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত ও পাঠদানেরঅনুমতির অপেক্ষাধীন ৯৬০টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার ৭৯৬ শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন।জাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা এখন সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের মতোবেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা পাবেন।
জাতীয়করণের ঘোষণা উপলক্ষে বাংলাদেশবেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ‘মহাসমাবেশের’ আয়োজন করে। এ উপলক্ষে সকালথেকেই সারা দেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষক কনকনে শীত উপেক্ষা করে সমাবেশস্থলেআসতে থাকেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দিতে শুরু করেজাতীয়করণের ঘোষণা দিলে শিক্ষকেরা করতালি ও স্লোগান দিয়ে এ ঘোষণাকে স্বাগতজানান।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একসঙ্গে ৩৬হাজার ১৬৫টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন। তখন এক লাখ ৫৫হাজার ২৩ জন শিক্ষক সরকারি হন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বিষয়টিউল্লেখ করে বলেন, ‘আমি মনে করি, পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম।’ শিক্ষকদেরজাতি গড়ার কারিগর হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকেরাই একটি জাতিকেগড়ে তুলতে পারেন। শুধু পড়ালেই হবে না, শিক্ষার মানও বাড়াতে হবে।’
বেসরকারিপ্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বেমহাসমাবেশে আরও বক্তব্য দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সমিতির উপদেষ্টা মহীউদ্দীন খান আলমগীর, প্রাথমিক ওগণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, ভারপ্রাপ্ত সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন, সমিতির মহাসচিব মুনছুর আলী।
বেতন-ভাতা কত বাড়বে: প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণারপরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্যসুযোগ-সুবিধা এখন সরকারি শিক্ষকদের সমান হবে। এত দিন তাঁরা শুধু সরকারিশিক্ষকদের মতো মূল বেতন পেয়ে আসছেন। এর মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষকের মূল বেতন পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা ও প্রশিক্ষণবিহীনদের পাঁচ হাজার ২০০টাকা। আর প্রশিক্ষণ করা সহকারী শিক্ষকদের মূল বেতন চার হাজার ৯০০ টাকা ওপ্রশিক্ষণবিহীনদের চার হাজার ৭০০ টাকা। এর বাইরে বেসরকারি শিক্ষকেরাবাড়িভাড়া মাসে সর্বসাকল্যে ২০০ ও চিকিৎসা ভাতা ২০০ টাকা করে পান। আর বছরেএকটি উৎসব ভাতা দুবারে ভাগ করে দেওয়া হয়। তাঁরা কোনো পেনশন পান না।
বিপরীতেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মূল বেতনের পাশাপাশি বাড়িভাড়াএলাকাভেদে মূল বেতনের ৫৫ থেকে ৬৫ শতাংশ, চিকিৎসা ভাতা মাসে ৭০০, নাশতা ভাতা১৫০, যাতায়াত ১৫০ টাকা ও উৎসব ভাতা পান বছরে দুটি। এ ছাড়া, আছে চাকরিজীবনেতিনটি টাইম স্কেল ও প্রতিবছর বেতন প্রবৃদ্ধি। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাজানিয়েছেন তিন স্তরে জাতীয়করণের জন্য বছরে অতিরিক্ত খরচ হবে ৬৫১ কোটি টাকা।
খুশিমনে শিক্ষকদের বাড়ি ফেরা: প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা শোনার জন্য হাজারো শিক্ষকঅধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যখন জাতীয়করণের কথাটি ঘোষণাকরেন, শিক্ষকদের চোখে-মুখে তখন অশেষ খুশির ঝলক। তুমুল করতালি ও স্লোগানদিয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে স্বাগত জানান।
সমাবেশ শেষে কয়েকজনশিক্ষক প্রথম আলোকে তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এটা তাঁদের জন্য বিশালআনন্দের বিষয়। কারণ, এখন তাঁরাও পুরোপুরি সরকারি শিক্ষক হলেন।
২৮ বছরধরে চাকরিরত ভোলার সদর উপজেলার শিক্ষক মু. শাহ আলম বলেন, ‘আমার জীবনের শেষমুহূর্তে এটা হবে, কল্পনা করতে পারিনি। এখন নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।’
কুমিল্লার বুড়িচংয়ের শিক্ষক ফয়জুন্নেসা বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য এক বিশাল পাওয়া।’
অনেক শিক্ষক গতকালই তাঁর পরিচয় দেওয়ার সময় নিজের বিদ্যালয়ের নামের আগে ‘সরকারি’ শব্দটি জুড়ে দেন। এ রকমই ছিল তাঁদের খুশির মাত্রা।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৫ মে শাহবাগ মোড়ে আন্দোলনরত বেসরকারি শিক্ষকদের বেদম প্রহার করেপুলিশ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ মে শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয়করণেরনীতিগত ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর জাতীয়করণের প্রস্তুতি শুরু করেপ্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নিউজরুম