ঢাকা (১০জানুয়ারী) : দৃশ্য-
১: দেশের প্রায় ২৬ হাজার ২০০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে এসব বিদ্যালয়ে কর্মরত এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষক সরকারি শিক্ষক হলেন।
এখন তাঁরা সবাই সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো সমান সুযোগ-সুবিধা পাবেন। বর্তমানে তাঁরা কেবল সরকারি শিক্ষকদের মতো মূল বেতন পান।বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে শিক্ষকদের মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দেন। এ সময় হাজার হাজার শিক্ষক করতালি ও স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে স্বাগত জানান। আর সবার চোখে মুখে হাসি আর খুশীর ঝলক।
দৃশ্য-২:
এমপিওভুক্তির দাবিতে ৩য় দিনের মতো বুধবার সকালে প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হয়েছিলেন সারাদেশ থেকে আসা মাধ্যমিক ও দাখিল পর্যায়ের নন এমপিও শিক্ষকরা। উদ্দেশ্য শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয় ঘেরাও। কিন্তু বিধি বাম। ঘেরাও তো দূরের কথা।
শিক্ষকরা বিক্ষিতভাবে প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়। মরিচের গুড়া স্পে করে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক শিক্ষককে লাঠিপেটাও করতেও দেখা গেছে। দুপুরের পর থেকে প্রেসক্লাব এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয় র্যাব-পুলিশ।
শিক্ষকরা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় শিক্ষকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে।পুলিশ টিয়ার গ্যাস সেল, রাবার বুলেট এবং মরিচের গুঁড়ার (পিপার) স্প্রে করে শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পল্টন মোড় থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
শিক্ষক নেতারা দাবি করেছেন, এমপিওভুক্ত হওয়ার যোগ্য প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরে যাবেন না এবং দাবি মেনে না নিলে পরে আরো কঠোর কর্মসূচি দেবেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুধার্ত এসব শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বসতে চাইলেও পরে তিনি আর সময় দেননি বলেও জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারা।
কি বিচিত্র সেলুকাস দেশ। রেজিস্টার্ড প্রাথমিকের শিক্ষকরা সরকারিকরণ হবে এমনটি একসময় স্বপ্নও দেখতেন না। কারণ তারা জানতেন তাদের সঙ্গে সরকারি প্রাথমিকের কত দূরত্ব। সেই তারাই আন্দোলনের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত জাতীয়করণের ঘোষণা পেলেন। তবে সাধুবাদ প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি এতো বড় সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন।
জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত শিক্ষকদের মহাসমাবেশে জাতীয়করণের ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষকদের এ দাবি কতটা যৌক্তিক, আমি সেটা উপলব্ধি করেছি। ওনারা শুধু রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ চেয়েছেন। কিন্তু আমি সবারটাই করে দিলাম। কাজেই এখন সরকারীকরণের আশায় নতুন করে যত্রতত্র বিদ্যালয় করলে অনুমোদন দেওয়া হবে না। বিদ্যালয় করতে হলে সরকারিভাবে করা হবে।’ প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর শুভেচ্ছাবার্তা নিজ নিজ এলাকায় পৌঁছে দিতে শিক্ষকদের অনুরোধ জানান।
তবে দু:খ একটাই। রাস্তায় মার খাওয়া এই শিক্ষকরাতো এমপিও চেয়ে কোনো অন্যায় করেননি। তারা বিনা পয়সায় দিনের পর দিন পাঠদান করে চলছেন। এমপিও হওয়া অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের রেজাল্ট অনেক অনেক ভালো। এই শিক্ষকরা এর আগেও প্রেসক্লাবের সামনে আমরন অনশন করেছেন, কাফনের কাপড় গায়ে দিয়ে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে।
মানবাধিকার চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এসে সংহতিও জানিয়েছেন। তখনও তাদের ওপর পুলিশি হামলা হয়েছিল। ওই সময় একজন বয়স্ক শিক্ষক পুলিশকে লক্ষ্য করে বলছিলেন, আমার ছেলেও পুলিশ। তাহলে তোমরা এভাবে বাবা তুল্য মানুষের গায়ে হাত তোলো।তোমরা কী কোন স্কুলে পড়োনি। শিক্ষকের মর্যাদা কবিতাটি একটুকুও মনে পড়েনা।
সে যাক কথা। বুধবারতো পুলিশের রমনা জোনের উপকমিশনার সৈয়দ নুরুল ইসলাম আন্দোলনকারী শিক্ষকদের জামায়াত বানিয়ে ছেড়েছেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা গতকালের মতো আজও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছি। কিন্তু আপনারা দেখেছেন, তাঁরাই পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছেন। একপর্যায়ে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপে বাধ্য হয়েছে। আমাদের ধারণা, এ হামলা জামায়াত করেছে। শিক্ষকদের আচরণ এমন হতে পারে না। শিক্ষকদের প্রতি আমাদের যে দুর্বলতা আছে, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জামায়াত এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’
এমনকি ৠাব-পুলিশের সশস্ত্র অবস্থার মুখে সংঘর্ষের ঘটনায় রমনা জোনের সহকারী কমিশনার শিবলী নোমানসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন বলে দাবিও করেছেন পুলিশের এ কর্মকর্তা।
আমার জানামতে শিক্ষকদের হাতে কোনো ব্যাগ পর্যন্ত ছিলনা। তারা অনেকেই পুলিশের ছোড়া টিয়ারগ্যসে থেকে বাঁচতে পত্রিকা রেখেছিলেন কাছে। আন্দোলনে আসা এক শিক্ষক আমার বাসায় ভোরে এসেছিলেন। আমি তাকে নতুন বছরের ক্যালেন্ডারসহ একটি ফাইল তাকে দিতে চাইলে তিনি না নিয়ে বলছিলেন, পুলিশ যেভাবে পিছু নেয় তাতে ফাইল এমনিতেই পরে যাবে। আপনি পরে দিয়েন।
স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির (বেতন-ভাতা বাবদ মাসিক সরকারি টাকা) দাবিতে পালিত কর্মসূচির ২য় দিন মঙ্গলবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (শিক্ষা ভবন) ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
সরকার যদি শিক্ষকদের রাস্তায় না চাইতেন অন্তত: শিক্ষামন্ত্রী না হয়, সচিব প্রাথমিকভাবে তাদের ডেকে নিতে পারতেন। তিনি শিক্ষামন্ত্রী প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও তাদের নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে পারতেন।
বুধবার বিকেল ৪টায় লাগাতার তৃতীয় দিনের অবস্থান ধর্মঘট শেষে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রেসক্লাবের সামনে এ অনশন চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষকরা।
সংবাদকর্মী হিসেবে মনে পড়ে, আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালের প্রথমদিকে শিক্ষামান বিবেচনায় এমপিও দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাধ সাধেন সাংসদরা। একপর্যায়ে তাদের কাছে তালিকা চাওয়া হয়। আর তখনি ভেস্তে যায় নীতিমালা মেনে এমপিওভুক্তির উদ্যোগ।
যাই হোক প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে শিক্ষামন্ত্রী ও স্বজ্জন হিসেবে পরিচিত নূরুল ইসলাম নাহিদের করা এমপিও তালিকায় স্থান পায় সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার রাজিবপুর দাখিল মাদ্রাসা। কিন্তু এর কিছু দিন পরেই শর্ত পূরণ না করলেও প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দীনের সুনজরের কারণে উপদেষ্টার করা তালিকায় জায়গা করে নেয় আরেকটি মাদ্রাসা। আর এই তালিকায় বাদ পড়ে রাজিবপুর দাখিল মাদ্রাসা। এটি এখন পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অন্যান্য শর্তের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত হতে হলে নূন্যতম ২০ জন পরীক্ষার্থী দাখিল কিংবা সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করতে হবে ৫০ শতাংশ। কিন্তু শর্ত পূরণ না করে শুধু্ উপদেষ্টার সুনজর এনে দেয় অন্য মাদ্রাসার এমপিওভুক্তির সুযোগ।
যদিও রাজিবপুর মাদ্রাসা এমপিও’র জন্য সুপারিশ ছিল স্থানীয় সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয় ও পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার এমপি’র। ওই সময় এ রকম অনেক অভিযোগই ওঠে।
নন এমপিও শিক্ষকদের অভিযোগ, প্রয়োজনীয় শর্ত না থাকলেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বীকৃতি এবং এমপিওভুক্ত হয়। অথচ শহর-গ্রামাঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠান শর্ত থাকলেও এমপি-মন্ত্রীদের সুনজর না পেয়ে এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে নিদারুণ কষ্টে আছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী।
যে কথা বলছিলাম, দাবির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিবের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনায় বসেও কোনো আশ্বাস না আসায় ১ অক্টোবর থেকে তারা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নন এমপিও শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। ৪ অক্টোবর সচিবালয় ঘেরাও করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হন শিক্ষক-কর্মচারীরা।
পরে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বসার আশ্বাস দিলেও তারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করে স্কুল-মাদ্রাসায় ফিরে যান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেশ ক’বার বসার তারিখ দেওয়া হলেও সেই বসা আর হয়নি। অবশেষে শিক্ষকরা আবারও রাস্তায় নামলো।
শিক্ষকদের দাবি কি খুবই অযৌক্তিক। আজকে যদি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে প্রাথমিকের লাখো শিক্ষকের খুশীর দিনে অভাব অনটনে থাকা মাধ্যমিক-দাখিল পর্যায়ের এ শিক্ষকদের জন্য আশ্বাসও দিতেন। তাদের জন্য কম সময়ের মধ্যে কিছু করবেন এমন ঘোষণা দিতেন। তবে কতই না ভালো হতো।
আন্দোলন করতে এসে যতই পুলিশি মারধরের শিকার হোক না কেন মানুষ গড়ার এ কারিগরেরা, তারা অনেক আনন্দে বাড়ি ফিরে যেতো বলে আমার বিশ্বাস। আর কৃতজ্ঞ থাকতো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে। আর আজকের দিনটিই হতো শিক্ষক সমাজের জন্য এক অনন্য দিন। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যও।
সংগঠনের সভাপতি মো: এশারত আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের অপেক্ষায় এখনও আছি।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক দিক বিবেচনায় হলেও শিক্ষকদের প্রতি সদয় হবেন বলে প্রত্যাশা এ শিক্ষকনেতার।
সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলবো, ২০১৩ সরকারের জন্য যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। তেমনি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে আবারও জনগণের কাছে যেতে হবে এ বছরেই। যে যাই বলুক তাদের মন জয়ের ওপরই নির্ভর করছে ২০১৪ এর জাতীয় নির্বাচনের ফল। নন এমপিও এ বিপুলসংখ্যক মানুষ শুধু শিক্ষকই নন, তারা একেকটি পরিবারেরও প্রধান।
দেশজুড়ে উন্নয়নের পাশাপাশি তাদের জন্য কিছু করতে পারলেই দল হিসেবে আওয়ামী লীগ জনগণের আরও কাছে যেতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
নিউজরুম